‘অখণ্ড স্বাধীন বাংলা’ রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টা কেন ব্যর্থ হয়েছিল?

অথবা, ‘অখণ্ড স্বাধীন বাংলা’ আন্দোলন কেন ব্যর্থ হয়েছিল?

উত্তর: ভূমিকা: বাংলাকে বিভক্তিকরণের পেছনে যাদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশী ছিল তারা কংগ্রেস। প্রথম দিকে সমর্থন দিলেও শেষে নিজেদের স্বার্থে কারণে তারা করে। অখণ্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের ব্যর্থতার কারণ ছিল বহুবিদ। তাছাড়া হিন্দু মুসলিম ছিল আলাদা জাতি। যদিও তাদের মধ্যে সম্প্রীতি বিরাজ করছিল তারপরও তারা একে অপরের থেকে বিভক্ত হওয়ার চেষ্টা করছিল। ফলে যে অখণ্ড বাংলা গঠনের প্রয়াস চালানো হয়েছিল তা ব্যর্থতায় পর্যবশিত হয়। অখণ্ড বাংলা বিভক্তির সাথে সাথে ভারত পাকিস্তান বিভক্ত হয় এ বিভক্তির কিছু আইন এর ভুল ছিল। নিম্নে প্রশ্নানুসারে আলোচনা উপস্থাপন করা হলো:

অখণ্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার প্রয়াস ব্যর্থতার কারণ: মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের বিরোধিতা বাংলার তৎকালীন নেতৃবৃন্দ যারা অখণ্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন আর তাদের এ পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার কারণগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো:

১. কংগ্রেসের বিরোধিতা: কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সাধারণ নেতৃবৃন্দ অখণ্ড বাংলাকে সমর্থন দিলেও কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের হাইকমান্ড অখণ্ড বাংলাকে কখনোই সমর্থন করেননি। সংগঠন দুটির বাংলা শাখায় যারা কেন্দ্রীয় হাইকমান্ডের অনুসারী ছিলেন তারা প্রথম দিকে অখণ্ড বাংলার দাবি সমর্থন করলেও শেষাবধি হাইকমান্ডের ভয়ে এর চরম বিরোধিতা করে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, বাংলা মুসলিম লীগের অন্যতম নেতা মাওলানা আকরম খাঁ এক পর্যায়ে হুঙ্কার ছেড়ে বলেছিলেন যে, কেবলমাত্র বাংলার মুসলমানদের লাশের উপর দিয়েই বাংলা ভাগ হতে পারে, অথচ তিনিই পরবর্তীতে এর চরম বিরোধিতা করেন।

২. হিন্দু বিরোধিতা: দীর্ঘ ১০ বছর ধরে হিন্দুদের বিরোধিতা সত্ত্বেও বাংলার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল মুসলমান সরকার। যার কারণে বাংলার অপর হিন্দু শ্রেণী হিংসাপরায়ন হয়ে ওঠেন। আর সে সময় তাদের ভিতর একটি কঠিন ডীতি কাজ করে যে তারা কখনোই বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনে হস্ত ক্ষেপ করতে পারবে না। আর তারা ভাবে অখণ্ড বাংলা হলে মুসলমানদের একক ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে আর তারা এইরূপ ধারণা করেই অখণ্ড বাংলাকে সমর্থন দান হতে বিরত থাকে। কলকাতার সম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্দেহ, অবিশ্বাস ও দূরত্ব সৃষ্টি করে।

৩. পৃথক কাঠামোগত কারণ: বাংলায় হিন্দু ও মুসলমান বসতি এমনভাবে গড়ে উঠেছিল যে পূর্ব বাংলার মুসলমানরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং পশ্চিম বাংলায় হিন্দুরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই বাংলার মুসলমানরা মনে করেছিল যদি অখণ্ড বাংলা গঠন করা হয় তাহলে বাংলার রাজনীতিতে একচ্ছত্র অধিপত্য কায়েম করবে হিন্দুরা। আবার হিন্দুরা মনে করেছিল যদি বাংলার অখণ্ডতা বজায় থাকে তাহলে মুসলমানরা বাংলার রাজনীতিতে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করবে। তাই উভয় সম্প্রদায় চাচ্ছিল বাংলা বিভক্ত হবে। তাছাড়া স্বভাবতই যেন এটা প্রাকৃতিকভাবেই বিভক্ত হয়েছিল। বাংলার সকল মিল কারখানা এবং কলকাতার। শহর পশ্চিম বাংলার সীমানায় ছিল। স্বভাবতই পশ্চিম বাংলা বিভক্ত হলে পশ্চিম বাংলার ক্ষতি ছিল না, বরং সেখানে হিন্দুদের পক্ষে চিরকাল প্রাদেশিক সরকার গঠন সম্ভবপর সুতরাং হিন্দুরা বাংলা বিভক্তির পক্ষে কথা বলেন। তাই বাংলার নেতারা বিশেষ করে পূর্ব বাংলার নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তা ব্যর্থতায় পর্যবেসিত হয়।

৪. সীমিত সময়: অখণ্ড বাংলা গঠনে যে পরিকল্পনা করা হয় তা ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল সময়ের স্বল্পতা। অখণ্ড বাংলার বিষয় ছিল আলোচনা শুরু হয় ১৯৪৭ সালে। আবার ১৯৪৭ সালের এপ্রিলেই অখণ্ড বাংলার বিষয়টি উত্থাপিত হয়। আবার এর কিছু দিন পরই ঘটে দেশ বিভাজন। স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তান বিভক্তি চূড়ান্ত হয়। সুতরাং তা বাস্তবায়নের জন্য এত কঠিন সময়ে দুই বা তিন মাস যথেষ্ট ছিল না। করা তৎকালীন ভারতের সবচেয়ে বড় দুটি রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে সমঝোতার বিষয়টি ছিল। আর সে সময় তাদের মধ্যে বিরাট কলহ কাজ করছিল। আবার সিলেটের মতো বাংলা বিভক্তির প্রশ্নে গণভোট করা যেত কিন্তু সময়টা এতই কঠিন ছিল যে সেটাও বাস্তবায়নের কোনো সময়ই হাতে ছিল না।

৫. উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাব: সেই সময় বাংলায় তেমন কোনো বড় ধরনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি। মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মতো শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের হাইকমান্ডে বাংলার উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব ছিল না। ফলে পশ্চিমা মুসলমান ও উত্তর ভারতের হিন্দু নেতৃত্ব তাদের নিজ নিজ স্বার্থে বাংলা বিভাগের বিষয়াদি বিবেচনা করেন। বৃহত্তর স্বাধীন বাংলা ভারতের হিন্দু পুঁজিপতি গোষ্ঠীর জন্য মাথাব্যথার কারণ ছিল। কলিকাতা ছিল হিন্দু পুঁজিপতি গোষ্ঠীর নাভীকেন্দ্র। গোটা বাংলা ও সারা ভারতের পুঁজি সংগঠক হিসাবে ইঙ্গমার্কিন ও মাড়োয়ারী গোষ্ঠী বিরামহীন গতিতে কাজ করছে তৎকালীন কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করে। সুতরাং বাংলা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে ইঙ্গ-মার্কিন ও মাড়োয়ারী পুঁজি বাঙালিদের হাতে যাবে এটা প্রায় নিশ্চিতভাবে অবাঙালি দেশী বিদেশী পুঁজি সংগঠকেরা বুঝতে পারেন এবং সে কারণেই তারা বাংলাকে ভারতের দুই অংশকে পরাধীন ভূমিতে রূপান্তর করার ষড়যন্ত্র করে।

৬. পূর্ব বাংলার প্রতি চক্রান্ত: অপরপক্ষে মুসলিম লীগের পশ্চিমা নেতৃবৃন্দ মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ববাংলাকে উপনিবেশ হিসাবে শোষণ করার উদ্দেশ্যে ঐ এলাকার পাকিস্তানের অংশ হিসেবে চেয়েছিলেন। তাদের এই অসৎ উদ্দেশ্যকে সহযোগিতা করেন পূর্ববাংলার খাজা নাজিম উদ্দিন, নুরুল আমিন, মাওলানা আকরাম খাঁ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। এরা ভাল করেই জানতেন যে অবিভক্ত বাংলা হলে তাদের পক্ষে সোহরাওয়ার্দী গ্রুপকে ডিঙিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার অসম্ভব তাই তারা কেবলমাত্র ক্ষমতার লোভেই খণ্ডিত পূর্ববাংলাকে স্বাগত জানান।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, যদিও সমগ্র ভারতে হিন্দু ও মুসলমানরা একে অপরের প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করে তবুও বাংলা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানকার জনগণ হিন্দু কিংবা মুসলিম জাতীয়তা বোধের পরিবর্তে বাঙালি জাতীয়তাবোধের দ্বারা মিলিত হয়ে অখণ্ড বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তারা স্বাধীনভাবে নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে জীবনযাপনে আগ্রহী ছিলেন। তাদের এই স্বপ্নের বহিঃপ্রকাশেই হচ্ছে ১৯৪৭ সালের অখণ্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের উদ্যোগ।