অথবা, ইবনে সিনার অধিবিদ্যা সম্পর্কিত তত্ত্ব ব্যাখ্যা কর।
অথবা, ইবনে সিনার অধিবিদ্যা সম্পর্কিত তত্ত্ব আলোচনা কর।
অথবা, অধিবিদ্যা সম্পর্কে ইবনে সিনার মতবাদ বিস্তারিত বর্ণনা কর।
অথবা, অধিবিদ্যা সম্পর্কে ইবনে সিনা কিরূপ মতবাদ দেন বিস্তারিত লেখ।
উত্তর: ভূমিকা: মুসলিম জাহানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ ইবনে সিনা তাঁর মনের গভীরতা, চিন্তাশক্তির প্রখরতা ও বিশ্বজনীন উদার দৃষ্টিভঙ্গির জন্য বিশ্বের সুধী সমাজে বিশেষভাবে সুপরিচিত। তিনি এরিস্টটলের দর্শনের একজন সফল ভাষ্যকার। তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় মুসলিম বিশ্বে এরিস্টটলের দর্শন চর্চা বিশেষভাবে প্রসারিত হয়। মুসলিম দর্শনে আল-ফারাবি যে নব্য প্লেটোবাদী ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সে ঐতিহ্যের প্রাচ্যদেশীয় শ্রেষ্ঠতম প্রবক্তা ও ব্যাখ্যাকারী ছিলেন ইবনে সিনা। তিনি আল-ফারাবির প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রথমেই গ্রিক দর্শনের সাথে পরিচিত হন। সমসাময়িক এমনকি পরবর্তীকালে পাঠক ও বিদগ্ধ সমাজে তাঁর মতাবলি সমর্থিত হয়েছিল বর্ণনায় স্বতঃস্ফূর্ত এবং রচনার গুণগতমানের উৎকৃষ্টতার জন্য।
ইবনে সিনার পরিচয়: ইবনে সিনার পুরো নাম আবু আলী আল হুসায়ন ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সিনা। ল্যাটিন ভাষায় তিনি আবি সিনা (Svicenna) এবং হিব্রুতে আবেন সিনা (Svensina) নামে পরিচিত। তিনি একাধারে দার্শনিক, চিকিৎসক, গাণিতিক, ও জ্যোতির্বিদ ছিলেন। তাঁর আত্মাজীবনীমূলক গুণাবলির বিবরণ হতে যা জানা যায়, তা হলো তিনি বুখারার কাছাকাছি উত্তর পারস্যের খার মাইমান নামক একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আগ্রহের বিষয় ছিল যুক্তিবিদ্যা, অধিবিদ্যা ও গণিতবিদ্যা। মাত্র ১০বছর বয়সে তিনি কুরআন পাঠ সম্পন্ন করেন। ইবনে সিনার মানসিক বৃত্তি এত দ্রুত স্ফুরণ ঘটতে থাকে যে, অতি অল্প সময়ে তিনি তার শিক্ষককে ছাড়িয়ে যান। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তিনি অল্প সময়েই ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। হিপোক্রাটাস কর্তৃক সৃষ্ট চিকিৎসাবিজ্ঞান গ্যালন পুনরুজ্জীবন করেন, আল রাজি একে সুসংবদ্ধ করেন এবং ইবনে সিনা এর পূর্ণতা দান করেন। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও স্বাধীন চিন্তার জন্য নানাভাবে রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের স্বীকার হন। অবশেষে ১০৩৭ সালে ৫৮ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। ইবরে সিনার অধিবিদ্যা অপরাপর মুসলিম চিন্তাবিদগণের মত ইবনে সিনা অধিবিদ্যা সম্পর্কীয় আলোচনা করেছেন। তবে লক্ষণীয় যে, অধিবিদ্যা ও পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে ইবনে সিনা আল-ফারাণি হতে স্বতন্ত্র, যদিও তিনি যুক্তিবিদ্যার ক্ষেত্রে ফারাবিকে অনুসরণ করেন। অর্থাৎ, অধিবিদ্যার ক্ষেত্রে আল-ফারাবি হতে তিনি ভিন্নমত পোষণ করেন। কেননা, আমরা দেখি যে, তিনি আধ্যাত্মিক শক্তিকে পার্থিব শক্তির বহু উর্ধ্বে উন্নীত করেছিলেন। শুধু তাই নয়, আধ্যাত্মিক ও পার্থিব জরের মধ্যবর্তী শক্তি হিসেবে আত্মার গুরুত্বের কথা তুলে ধরেন। তিনি নব্য প্লেটোবাদের মত খোদা হতে জড়ের অনুমান করেন নি। তাঁর মতে, খোদা শ্রেষ্ঠতম আধ্যাত্মিক সত্তা। তিনি সমস্ত জড় শক্তির উর্ধ্বে। আত্মা জড় ও আধ্যাত্মিক শক্তির মধ্যে বিদ্যমান দূরত্বকে লাঘব করে। আত্মায় জড়াত্মক ও আধ্যাত্মিক উভয়বিধ শক্তির সমন্বয়ে সাধিত হয়েছে। আত্মার দৈহিক ও আধ্যাত্মিক উভয় দিক রয়েছে।
সম্ভাব্য ও নিশ্চয়াত্মক সত্তা: অধিবিদ্যার আলোচনায় সম্ভাব্য ও নিশ্চয়াত্মক সত্তা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়। ইবনে সিনা সত্তার আলোচনার ক্ষেত্রে দু’ধরনের সত্তা তথা নিশ্চয়াত্মক ও সম্ভাব্য সত্তার কথা বলেছেন। সম্ভাব্য সত্তা হলো এমন সত্তা, যা অন্য কোন সত্তার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু নিশ্চয়াত্মক সত্তা এমন সত্তা, যা অন্য কোন সত্তার উপর নির্ভরশীল নয়। এ জগতে যা কিছু আছে সবই সম্ভাব্য সত্তা এবং এ সম্ভাব্য সত্তা নিশ্চয়াত্মক সত্তার নির্দেশ করে। De Bore তাঁর “History of Philosophy in Islam’ গ্রন্থে বলেছেন, “ইবনে সিনার মতে, নিশ্চয়াত্মক সত্তার অস্তিত্ব ও গুণ এক ও অভিন্ন।”
সম্ভাব্য ও অনিবার্য অস্তিত্ব: ইবনে সিনার মতে, অস্তিত্ব দুই প্রকার। যথা: ১. সম্ভাব্য অস্তিত্ব ২. অনিবার্য অস্তিত্ব। সম্ভাব্য অস্তিত্ব বলতে সসীম ও সাপেক্ষ সত্তাকে বুঝায়। সম্ভাব্য অস্তিত্ব অন্যান্য সত্তার উপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে, অনিবার্য অস্তিত্ব বলতে বুঝায় এমন সত্তা, যার উপর অন্যান্য সত্তা নির্ভরশীল। এ জগতে এবং বেহেশতে যা কিছু আছে তা সবই
সম্ভাব্য অস্তিত্ব। এ সম্ভাব্য অস্তিত্ব একটি অনিবার্য সত্তাকে নির্দেশ করে। ইবনে সিনা এ অনিবার্য সত্তাকে বলেছেন আল্লাহ।
বহুত্বের ধারণা: ইবনে সিনা পূর্বেই বলেছেন, অনিবার্য সত্তা হলো এক ও অদ্বিতীয়। অর্থাৎ, অনিবার্য সত্তার মধ্যে বহুত্ব নেই। কিন্তু তাই যদি হয়, তাহলে বহুত্বের ব্যাখ্যা কি হতে পারে? এ প্রসঙ্গে ইবনে সিনার মত হলো বিশ্বআত্মার
মধ্যেই রয়েছে বছত্বের ধারণা এবং এ বিশ্বআত্মা বা World Soul এর থেকেই বহুত্ব ও বৈচিত্র্যের উদ্ভব হয়েছে। বিশ্বআত্মা নিজ কারণ চিন্তা করে তৃতীয় শক্তি বা Third Spirit সৃষ্টি করেছেন। এ তৃতীয় শক্তি নিজ কারণ চিন্তা করে আত্মা সৃষ্টি করেছে। এ সৃষ্টি প্রক্রিয়ার সর্বশেষ শক্তি হলো চালিকাশক্তি। এটি জড়জগৎ ও মানবাত্মার উপর কর্তৃত্ব করতে থাকে। আল্লাহ হতে প্রেমশক্তির সম্পর্ক সরাসরি প্রত্যক্ষ। অন্যান্য শক্তির সাথে তাঁর সম্পর্ক পরোক্ষ।
সত্তার অভিত্ব: ইবনে সিনার মতে, প্রত্যেক সত্তা তা সে ব্যক্তি কিংবা বস্তু যাহোক না কেন, তার অস্তিস্ব লাভ করে আল্লাহর ইচ্ছার মাধ্যমে। জগতে যেমন আছে ভালো, তেমনি আছে মন্দও। কিন্তু মন্দ আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতাকে সীমিত করে না। এটা সসীম জগতের জন্য অপরিহার্য। আল্লাহর দিক দিয়ে এটি একটি অনস্তিত্বশীল সত্তা, কিন্তু জগতে সসীম জীবনে প্রেক্ষাপটে মন্দ একটি মৌল অপরিহার্যতা। ইবনে সিনার মতে, জগতে যদি অকল্যাণ বা মন্দ না থাকত, তবে সম্ভবত সেটাই হতো আমাদের অকল্যাণ। বর্তমানে পৃথিবীতে যে অবস্থা বিদ্যমান তাই সবচেয়ে উত্তম ও সুন্দন, এর চেয়ে বেশি ভালো বা সুন্দর হতে পারে না। আল্লাহ বিশুদ্ধ সত্তা, আর তাই তিনি কেবল সার্বিককেই জানেন, বিশেসকে নয়।
মুতাজিলাদের সাথে তুলনা: সত্তা সম্পর্কিত ইবনে সিনার মতের সাথে মুতাজিলাদের মতের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। মুতাজিলাদের মত তিনিও বলেছেন, আল্লাহ কোন অন্যায় বা অমঙ্গল কাজ করতে পারে না বা করেন না। মুতাজিলারা মনে করেন, কোন অন্যায় বা অমঙ্গল কাজ করা আল্লাহর স্বভাব বা প্রকৃতি বিরুদ্ধ। লক্ষণীয় বিষয় হলো যে, ইবনে সিনা মুতাজিলাদের এ অভিমতের চেয়ে আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, ন্যায়-অন্যায়, মঙ্গল-অমঙ্গল কাজ করার সম্পূর্ণ শক্তি বা ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও মহান আল্লাহ তাঁর প্রকৃতি বা স্বভাববিরোধী কাজ করেন না বা কদরতে পারেন না। ফলে সত্তা সম্পর্কীয় মত পর্যালোচনা করে আমরা সহজেই বলতে পারি যে, ইবনে সিনার মতের সাথে মুতাজিলাদের মতের সাদৃশ্য রয়েছে।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, আরব সভ্যতায় প্রাচীন গ্রিসের জ্ঞানবিজ্ঞান এবং দর্শনকে সংযোজন করেন এবং আরব সভ্যতার মাধ্যমে ইউরোপে সে অমর জ্ঞান সম্ভারতে পৌছে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অতুলনীয়। তাঁর দর্শনে আমরা ভাববাদ ও বস্তুবাদ উভয় ধারণাই পাই। তিনি এডি, শূন্যতা, তাপ, আলো, স্থানিক আকর্ষণ প্রভৃতি ক্ষেত্র গবেষণা করেন। সে যুগে প্রচলিত আলকেমি বিদ্যার ধাতু রূপান্তরবাদকে তিনি স্বীকার করেন। ইবনে সিনা শুধু তাঁর যুগের চিন্তাধারার অগ্রদূত ছিলেন না, বরং তাঁর দার্শনিক মতবাদ অনেক ক্ষেত্রে আধুনিক দর্শনসহ পরবর্তী দার্শনিক ঐতিহ্যের পূর্বাভাস। মূলত মুসলিম প্রাচ্যে আল-গাজালি পূর্ববর্তী চিন্তাবিদ তাঁর গত এত অধিক জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষস হতে পারেন নি।