অথবা, অসহযোগ আন্দোলন কেন ব্যর্থ হয়েছিল-ব্যাখ্যা কর। এবং এর ফলাফল কি ছিল?
উত্তর: ভূমিকা: ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের নির্যাতনের প্রতিবাদে এবং বিশ্বাসঘাতকতার কারণে শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন। খিলাফত আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল খিলাফত প্রতিষ্ঠা এবং অসহযোগ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল স্বরাজ লাভ। উভয়েই যৌথ উদ্যোগে ব্রিটিশ বিরোধী বিভিন্ন কর্মসূচির ঘোষণা করেন হরতাল অবরোধ ডেকে দেশ অচল অবস্থা সৃষ্টি করেন, কিন্তু এ আন্দোলন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বিভিন্ন কারণে এ আন্দোলন ব্যর্থ হয় তবে এ আন্দোলন ব্যর্থ হলে ও ভারতীয়জনগণের মধ্যে সরকারের শাসনের ভিত্তিকে একটু হলেও দুর্বল করে। ভারতবাসীকে এ আন্দোলন যে চেতনার সঞ্চার করেছিল একদিন সে পথ ধরেই ভারতের স্বাধীনতা ফিরে আসে সেজন্য এ আন্দোলন ভারতেবর্ষের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করেছিল এবং এ আন্দোলনের মাধ্যমে মহাত্মা গান্ধীও সারা বিশ্বে একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
অসহযোগ আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার কারণ: অসহযোগ আন্দোলন নানা কারণেই ব্যর্থ হয়েছিল। নিম্নে সেগুলো বর্ণনা করা হলো:
১. মালবারের হত্যাকাণ্ড: দক্ষিণ ভারতের মালাবারে ১৯২২ সালে দুর্ধর্ষ মুসলমানগণ বিদ্রোহী হয়ে কয়েকজন ইউরোপীয় ও বহু হিন্দুকে হত্যা করে। এ ঘটনার গান্ধীজী হতাশা ব্যক্ত করে ক্ষুদ্ধ হয়ে সাময়িকভাবে অসহযোগ আন্দোলন স্থগিত করে। যা এই আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম একটি কারণ ছিল।
২. সুদক্ষ সাংগঠনিক অভাব : অসহযোগ আন্দোলনকে সফল করার জন্য যে সুদক্ষ সংগঠকের দরকার ছিল তা দলের ঘোষণা এবং পরিবেশ পরিস্তিতি বুঝে আন্দোলনে কলা কৌশল নেতাদের মধ্যে ছিল না। ফলে আন্দোলনে নতুন নতুন কর্মসূচি পরিবর্তন করা সেগুলোর যথেষ্ট অভাব লক্ষ করা যায়। যার জন্য এক সময়ে এ আন্দোলন ব্যর্থতায় পরিণত হবে।
৩. গান্ধীজী সিদ্ধান্ত পরিবর্তন গান্ধীজী কিছু অপ্রীতিকর ফলে এ ঘটনার জন্য অসহযোগ আন্দোলন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেন। সেটি ছিল মারাত্মক একটি ভুল। আর এই সুযোগে ব্রিটিশ সরকার অসহযোগ আন্দোলনকে নির্মল করার জন্য মাঠে নেমে পড়ে। কংগ্রেসের অনেক নেতাই গান্ধীজীর এই সিন্ধান্তের প্রতিবাদ করেছিল কিন্তু গান্ধীজী কানে নেন নি। আন্দোলন ব্যর্থতার দিকে ধাবিত হয়।
৪. সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা: খিলাফত আন্দোলনের শুরুর দিকে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছিল। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রচেষ্টার দ্বারা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন জোরদার করতে পেরেছিল। কিন্তু এই সুসম্পর্ক বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯১৯, ১৯২১, ১৯২২ এবং ১৯২৩ সালে ভারতের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার খবর কোনো যায় এবং সেটি সমস্ত ভারতে ছড়িয়ে পড়ে ফলে এ, আন্দোলনের উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়।
৫. চৌরাচৌরার হত্যাকাণ্ড: ভারতের উত্তর প্রদেশের গোরক্ষপুরের কাছে চৌরাচৌরা থানায় ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একদল সহিংস জনতা ২১ জন পুলিশ কর্মীকে জীবন্ত দগ্ধ করে হত্যা করেন। গান্ধীজী এ ঘটনায় খুবই মর্মাহত হন এবং সাময়িকভাবে আন্দোলন স্থগিত করার সিন্ধান্ত নেন।
৬. ইংরেজ সরকারের নিপীড়নমূলক নীতি: ইংরেজ সরকার অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনে উদ্বিগ্ন হয়ে গণহারে খিলাফত ও অসহযোগ নেতাদের গ্রেফতার করতে থাকেন। ফলে অসহযোগ আন্দোলনে নেতাশূন্য হয়ে পড়ে। গান্ধীজীর একার পক্ষে এ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। ফলে গান্ধীজী ১৯২২ সালে এ আন্দোলন বন্ধ করতে বাধ্য হন।
অসহযোগ আন্দোলনের ফলাফল : অসহযোগ আন্দোলন ব্যর্থ হলেও এর ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারি। নিম্নে সেগুলো আলোচনা করা হলো:
১. নাগরিক অধিকারবোধের ধারণা: ভারতবর্ষে অসহযোগ আন্দোলনের পূর্বে যতগুলো আন্দোলন, সংগ্রাম সংঘঠিত হয়েছে; সেখানে সবধরনের মানুষের উপস্থিতি ছিল না, কিন্তু অসহযোগ আন্দোলনে ভারতবর্ষের প্রায় সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করে। ফলে ভারতীয় জনগণের মধ্যে নাগরিক অধিকারবোধ জাগ্রত হয়।
২. কংগ্রেসের বিভক্তি : অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে গান্ধীজীর সাথে কংগ্রেস নেতাদের মতপার্থক্য লক্ষ করা যায়। গান্ধীজির হঠাৎ করে অসহযোগ আন্দোলনে স্থগিত, আইনসভা বর্জন নীতি প্রভৃতির প্রতিবাদে চিত্তরঞ্জন দাস, মতিলাল নেহেরু প্রমুখ নেতারা কংগ্রেস ত্যাগ করে স্বরাজ পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করে। ফলে কংগ্রেসের গুরুত্ব অনেকখানি কমে যায়।
৩. রাজনৈতিক চেতনার সঞ্চার : অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতবাসীর মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার সঞ্চার হয়। এ আন্দোলন ছিল নিরস্ত্র ভারতবাসীর সশস্ত্র ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম আন্দোলন। এই চেতনাবোধই ভারতবাসীকে পরবর্তীতে স্বাধীনতার মুখ দেখিয়েছিল।
৪. গান্ধীজীর পরিচিত : অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে গান্ধীজী ভারত তথা সমগ্র বিশ্বে একজন ত্যাগীনেতা হিসেবে পরিচিত লাভ করে। মূলত গান্ধীজীর পরিচালনায় এই আন্দোলন এত বেগবান হয়েছিল। তাই তার সুখ্যাতি আজ সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে আছে।
৫. হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের টানাপোড়ান: এ আন্দোলনের শুরুর দিকে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে যথেষ্ট সুসম্পর্ক ছিল এবং তারা ঐক্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিত। কিন্তু পরবর্তীতে কয়েকটি হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা এ সম্পর্ককে নষ্ট করে দেয়। যদিও আন্দোলন শেষে পরে আবার উভয়ের মধ্যে ধীরে ধীরে সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়।
৬. কংগ্রেসের শক্তি: অসহযোগ আন্দোলনে প্রচার প্রচারণা প্রভৃতির মাধ্যমে কংগ্রেস ভারতে নিজেদের একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করে। আর কংগ্রেস সুসংবদ্ধ ও সুনিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক দল হিসেবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রথম আন্দোলনে নামে।
৭. ইংরেজ শাসকশ্রেণির মধ্যে সচেতনতাবোধ: ভারতবর্ষে খিলাফত এবং অসহযোগ আন্দোলনে ব্রিটিশ সরকার কিছুটা উদ্বিগ্ন হয় এবং ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি কিছুটা হলেও দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ফলে ব্রিটিশ সরকার এ আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে পরবর্তীতে তাদের শাসন পরিচালনার কৌশল পরিবর্তন হয়। এই আন্দোলন ব্রিটিশ শাসক শ্রেণিকে যথেষ্ট সচেতন করেছিল।
উপসংহার: শেষকথায় বলা যায় যে, গান্ধীজী যে উদ্দেশ্য নিয়ে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেছিলেন সেই উদ্দেশ্য হাসিলের বদলে ব্রিটিশ হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে দিনে দিনে সংঘর্ষ বেড়েই চলছিল। তাই গান্ধীজি অনুভব করলেন এ আন্দোলনে জনতা ও পুলিশ মারমুখী হয়ে পরস্পরকে আক্রমণ করুক সেটা হতে পারে না। সেজন্য তিনি তিনদিন অনশন পালন করেন এবং ভারতীয় জনগণকে সংগ্রাম বন্ধ করার অনুরোধ জানান ও গণ-অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন।