অথবা, জন অস্টিনের সার্বভৌম তত্ত্বের নেতিবাচক দিকগুলো বর্ণনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সার্বভৌমত্বের ধারণা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয়। তবে সার্বভৌমিকতার অর্থ ও প্রকৃতি সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে বিভিন্ন রকম মত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। মূলত সার্বভৌমত্ব ধারণাটি হচ্ছে আধুনিক রাষ্ট্রের ভিত্তি। সার্বভৌমত্ব হলো রাষ্ট্রের প্রাণস্বরূপ। সার্বভৌমত্ব একক, অবাধ, চূড়ান্ত এবং অভিভাজ্য ক্ষমতা। সার্বভৌমত্ব ছাড়া বর্তমান যুগে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। অস্টিনের সার্বভৌমত্ব তত্ত্ব যদিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ তারপরও এই সার্বভৌমত্ব বেশ কিছু সমালোচনার সমুখীন হয়েছে।
সমালোচনা: বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন অস্টিনের সার্বভৌমত্ব তত্ত্বকে নিম্নলিখিতভাবে সমালোচনা করেছেন:
১. যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবহায় অচল : যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সার্বভৌম ক্ষমতার অবস্থান নির্ণয় করা যায় না। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় বা অঙ্গরাষ্ট্রীয় কোন সরকারই সার্বভৌম নয়। উভয় সরকারই সংবিধানের গণ্ডির মধ্য থেকে ক্ষমতা চর্চা করে।
২. প্রথাগত আইনকে উপেক্ষা : অস্টিন আইনকে সার্বভৌমের আদেশ বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু লাঙ্কির মতে, “আইন ছাড়াও রাষ্ট্রের কিছু প্রথাগত বিধান থাকে। সার্বভৌম এসব প্রথাগত বিধান অস্বীকার করতে পারে না।”
৩. রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের প্রতি উপেক্ষা : অস্টিন আইনগত সার্বভৌমত্বের প্রতি অত্যধিক গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করেছেন।
৪. গণতান্ত্রিক নীতি বিরুদ্ধ: এ তত্ত্ব জনগণের সার্বভৌমত্বের উপর কোন গুরুত্বই প্রদান করে নি। জনশক্তিকে এটি উপেক্ষা করেছে। এজন্য এ তত্ত্ব গণতান্ত্রিক নীতি বিরুদ্ধ।
৫. অনগণ শান্তির ভয়ে আইন মেনে চলে: অস্টিনের মতে, “শাস্তির ভয়ে জনগণ আইন মান্য করে।” মালোচকদের মতে, শুধু শাস্তির ভয়ে মানুষ আইন মেনে চলে একথা ঠিক নয়। ধর্মীয় অনুশাসন, রীতিনীতি মানুষের আইন মান্য করার অন্যতম কারণ বলে বিবেচিত।
৬. আন্তর্জাতিকতাবাদীদের সমালোচনা: আন্তর্জাতিকতাবাদীদের মতে, বর্তমানে কোন রাষ্ট্রই চরম বাহ্যিক সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয়। প্রতিটি রাষ্ট্রকেই বর্তমানে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে হয়। সুতরাং অস্টিনের আইনগত সার্বভৌমত্বের তত্ত্ব বা একত্ববাদ গ্রহণযোগ্য নয়।
৭. প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্ব: অস্টিনের একত্ববাদ প্রতিক্রিয়াশীলতাকে প্রশ্রয় দেয়। কেননা তার সার্বভৌমত্ব তত্ত্বে ধনিক, বণিক, ক্ষমতাবান ও মুষ্টিমেয় শ্রেণিকেই সরকার গঠনে প্রলুব্ধ করে; সকল জনগণকে নয়।
৮. বহুত্ববাদীদের সমালোচনা: বহুত্ববাদীদের মতে, “রাষ্ট্র ছাড়াও বিভিন্ন গোষ্ঠী, সামাজিক, অর্থনৈতিক বা ধর্মীয় সংগঠন রয়েছে, যেগুলোর অস্তিত্ব রাষ্ট্র কর্তৃক সৃষ্ট নয় বা রাষ্ট্রের উপর এদের অস্তিত্ব নির্ভরশীল নয়।” বহুত্ববাদীদের মতে, এসব সংঘ ও প্রতিষ্ঠানসমূহ রাষ্ট্রের মতোই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সার্বভৌম।
৯. অপ্রতিহত ক্ষমতার ধারণা ঠিক নয়: অস্টিন আইনানুগ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলেছেন যে, সার্বভৌম ক্ষমতা চূড়ান্ত, অবাধ ও অসীম। এ ক্ষমতা অন্য কোন শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। কিন্তু বাস্তবে আজ পর্যন্ত কোন সার্বভৌম সম্পূর্ণ অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী হয় নি।
১০. পীড়নমূলক শক্তির উপর অত্যধিক গুরুত্বারোপ: অস্টিন পীড়নমূলক শক্তির উপর অত্যধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি নিয়ম শৃঙ্খলার পূর্বে শক্তিকে স্থান দিয়েছেন। তাঁর মতে, শক্তি প্রয়োগ বা শাস্তির ভয়ে লোক আইন মান্য করে চলে। বস্তুত এ কথা ঠিক নয়, নানা কারণে লোক আইন মানতে অভ্যন্ত বলেই আইন কার্যকরী হয়।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে অস্টিনের মতবাদ শুধু গুরুত্বপূর্ণই নয়, তা সার্বভৌমত্বের মর্যাদা বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে। তবে বহুত্ববাদীদের সমালোচনা অনুযায়ী জনমত, প্রথা প্রভৃতিকে একেবারে গুরুত্বহীন করা অস্টিনের পুরোপুরি ঠিক হয়েছে কি না এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কিন্তু একথাও সত্য যে, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যত সংঘ বা প্রতিষ্ঠানই থাককু না কেন, সেগুলোকে পুরোপুরি স্বাধীনতা প্রদান না করে তাদের উপর কিছুটা হলেও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ রাখা উচিত। গার্নার এর মতে, “সার্বভৌমিকতার আইনগত চরিত্র বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অস্টিনের তত্ত্ব মোটের উপর সুস্পষ্ট ও যুক্তিপূর্ণ।”