অথবা, সাম্প্রতিক সময়ে আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারণ কী?
উত্তর: ভূমিকা: আধুনিক গণতান্ত্রিক বিশ্বে আইনসভার যে ক্ষমতা থাকার কথা তা আজ অনেকাংশে কমে যাচ্ছে। আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। ফলে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে। স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারণ: নিম্নে আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারণ আলোচনা করা হলো। যথা:
১. জনমত গঠনের ক্ষেত্রে আইনসভার গুরুত্ব হ্রাস: জনগণের রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার এবং জনমত সংগঠনের ক্ষেত্রে আইনসভার ভূমিকাকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হতো। এখন বেতার, দূরদর্শন, সংবাদপত্র প্রভৃতি গণসংযোগের মাধ্যমগুলো জনমত গঠন ও প্রকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। এ কারণেও আইনসভার মর্যাদার হানি ঘটেছে।
২. দলীয় ব্যবস্থার কঠোরতা: বর্তমানে সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আইনসভা কার্যত সরকারের আজ্ঞাবহ ভূত্যের ভূমিকা পালন করে। সুসংগঠিত দলীয় ব্যবস্থা, কঠোর দলীয় নিয়মানুবর্তিতা প্রভৃতির ভিত্তিতে মন্ত্রিসভা আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকে। আবার প্রধানমন্ত্রী আইনসভাকে ভেঙে দেয়ার ভয় দেখিয়ে আইনসভাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। অধ্যাপক জেনিংস বলেছেন, “…..In another and more practical sense the government controls the house of commons.” এর ফলে আইনসভার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়ে শাসন বিভাগের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
৩. শাসন বিভাগের হন্ডে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা অর্পণ : বর্তমান জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহুবিদ্ধ আইনের প্রয়োজন হয়। আইনের জটিলতা, সদস্যদের আন ও অভিজ্ঞতার অভাব, সর্বোপরি সময়ের অভাবের জন্য আইনসভা আইন প্রণয়নের কিছু কিছু ক্ষমতা বাধ্য হয়ে শাসন বিভাগের হাতে সমর্পণ করেছে। ফলে শাসন বিভাগকে কিছু কিছু আইন প্রণয়ন করতে হয়। একে অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন বলে। এ অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইনের এক্তিয়ার যত বাড়বে শাসন বিভাগের ক্ষমতা তত বাড়বে এবং আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পাবে।
৪. জনকল্যাণমূলক দায়িত্বের সম্প্রসারণ: বর্তমানে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনকল্যাণমূলক কার্যকলাপের সিংহভাগই শাসন বিভাগ সম্পাদন করে। সমাজকল্যাণমূলক কাজকর্মের বিপুল দায়িত্বের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে আইনসভা এ ক্রমবর্ধমান দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। ফলে স্বভাবতই শাসন বিভাগের সাথে জনগণের ব্যক্তিগত ও দৈনন্দিন জীবনের গভীর সংযোগ স্থাপিত হয় এবং জনগণ শাসন বিভাগের প্রতি নির্ভরশীল ও আইন বিভাগ হতে ক্রমশ দূরে সরে যায়। আর এ কারণেই আইন বিভাগের ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।
৫. জরুরি অবস্থা ও সংকটকালীন প্রয়োজন: বিগত দু’টি মহাযুদ্ধ, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ঠান্ডা লড়াই এবং নিত্যনতুন সংকট ও আশঙ্কা, অর্থনৈতিক ও বহির্বাণিজ্যের সমস্যা প্রভৃতি বহুবিধ আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপের মোকাবিলার দায়িত্ব শাসন বিভাগ গ্রহণ করেছে। এছাড়া জাতীয় সংকট মোকাবিলা ও জরুরি প্রয়োজনে আইনসভা প্রয়োজনমতো দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার এটিও একটি অন্যতম কারণ বলে বিবেচিত।
৬. সদস্যদের অযোগ্যতা: দেশের জ্ঞানীগুণী ও বিদগ্ধ ব্যক্তিগণ সাধারণ নির্বাচনের বিড়ম্বনা ও জটিলতার মধ্যে নিজেদের জড়াতে চান না। ফলে অশিক্ষিত, অযোগ্য কিন্তু ক্ষমতালিন্দু ও স্বার্থপর ব্যক্তিদের দ্বারা আইনসভা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে আইনসভার গুণগত যোগ্যতা হ্রাস পায়। আইনসভার প্রতি জনগণের অনাস্থা সূচিত হয়। এ কারণে আইন বিভাগের প্রাধান্যের স্থলে শাসন বিভাগের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
৭. চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ভূমিকা : আগে আইনসভা সরকার এবং জনসাধারণের মধ্যে সংযোগ সাধনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করত। কিন্তু বর্তমানে চাপসৃষ্টিকারী ও সংগঠন জনগণের স্বার্থ ও সমস্যাদি সম্পর্কে সরকারের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এর ফলে জনগণ ও সরকারের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে আইনসভা গুরুত্ব হারিয়েছে।
৮. গণসংযোগের অভাব: বর্তমানে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসন বিভাগই নীতিনির্ধারণ এবং তা প্রয়োগের দায়িত্ব পালন করে। এ সূত্রে শাসন বিভাগ নানাভাবে জনগণের প্রাত্যহিক জীবনের সুখদুঃখ ও অভাব অভিযোগের সাথে জড়িয়ে পড়ে। আর এ কারণেই শাসন বিভাগের উপর জনগণের আস্থা ও নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে, আইনসভার গুরুত্ব ও মর্যাদা হ্রাস পেয়েছে।
৯. সংসদীয় শাসনের ব্যর্থতা : সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় যদিও আইনসভা বা সংসদ সকল কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু, তথাপিও দলীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সংসদ অনেক ক্ষেত্রেই দলীয় কার্যক্ষেত্রে পরিণত হয়।
উপসংহার: পরিশেষে আমরা বলতে পারি, উপর্যুক্ত যে সমস্ত কারণে আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে সে সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে হবে তাহলে আইনসভা কার্যকরী হবে।