অথবা, পাকিস্তানের ১৯৬২ সালের সংবিধান ব্যর্থ হয় কেন?
উত্তরঃ ভূমিকা: পাকিস্তানে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এ লক্ষ্যে ১৯৫৬ সালে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ইস্কান্দার মির্জা ক্ষমতা দখল করেন সামরিক আইন জারির মাধ্যমে। পরবর্তীতে তারই উত্তরসূরি আইয়ুব খান ক্যু এর মাধ্যমে ইস্কান্দার মির্জার কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করেন। অতঃপর আইয়ুব খান ক্ষমতা স্থায়ী করার জন্য ১৯৬২ সালে একটি সংবিধান প্রণয়ন করেন। কিন্তু এতে জনগণের গ্রহণযোগ্যতা না থাকায় তা ব্যর্থ হয়।
১৯৬২ সালের সংবিধান ব্যর্থতার প্রেক্ষাপট: ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলেও ভারত সংবিধান প্রণয়ন ও নির্বাচন করতে পারলেও পাকিস্তান তা করতে পারেনি। ১৯৪৭ সালে একটা গণপরিষদ গঠিত
হয়েছিল কিন্তু এ গণপরিষদ ১৯৫৪ সালের ২৫ অক্টোবর ইস্কান্দার মির্জা বাতিল ঘোষণা করেন। আদালতের মাধ্যমে ১৯৫৫ সালের ২৯ মে দ্বিতীয় গণপরিষদ গঠিত হয়। পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তান থেকে ৪০ জন করে মোট ৮০ জন নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হয়। দ্বিতীয়ত গণপরিষদ নিয়ে ১৯৫৫ সালের ৭ জুলাই পাকিস্তানের মারীতে প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এ অধিবেশনের ভিত্তিতে ১৯৫৬ সালে প্রথম সংবিধান প্রণীত হয় পাকিস্তানে। কিন্তু পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান সফলতার মুখ দেখতে ব্যর্থ হয়। যার প্রেক্ষিতে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা সামরিক শাসন জারি করেন। এ ঘটনার মাত্র ২০ দিন পরে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আইয়ুব খান পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। ফলে পাকিস্তানের গণতন্ত্রের সমাধি রচিত হয়। আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর ক্ষমতা দখলের প্রায় ৩ সপ্তাহ পূর্ব থেকে শুরু করে ১৯৬২ সালের জুন মাস পর্যন্ত ৪৪ মাস একটানা সামরিক আইন বা শাসন জারি করে চলে। আইয়ুব খানের অভিনব আবিষ্কার মৌলিক গণতন্ত্র এরই মধ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। এক অধ্যাদেশ বলে তিনি তা প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য করেন। ১৯৬০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি একটি শাসনতন্ত্র কমিশন নিযুক্ত করেন। ১৯৬১ সালের এ কমিশন রিপোর্ট পেশ করেন। এ কমিশনের রিপোর্ট মনঃপূত না হওয়ায় আইয়ুব খান ১৯৬২ সালের ১ মার্চ নিজের পছন্দমতো সংবিধান প্রণয়ন ও জারি করেন। এ সংবিধানে স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠে। কিন্তু এ সংবিধানে জনগণের অংশগ্রহণ ও জনগণের মতামত না থাকায় জনগণ এতে প্রতিবাদ করে ফলে আইয়ুব খানের এ সংবিধান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
১৯৬২ সালের সংবিধান ব্যর্থতার কারণ: ১৯৬২ সালের সংবিধান ছিল মূলত স্বৈরাচারী আইয়ুব খান শাসনের বৈধতার দাবি ও দীর্ঘকাল ক্ষমতা থাকার নীলনকশা। কিন্তু ছাত্রজনতা এ সংবিধানের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে ও সংবিধান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। নিচে ১৯৬২ সালের সংবিধান ব্যর্থতার কারণগুলো উল্লেখ করা হলো।
১. গণতন্ত্র হত্যা: জনগণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠায় ব্রিটিশ আমল থেকে আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছে। কিন্তু আইয়ুব খান তার সংবিধান রচিত করার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে হত্যা করেন। এছাড়া আইয়ুব খান রাজনীতিবিদদের পছন্দ করতেন না। তিনি ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি অসহিষ্ণু ও অনুদার। তাই তিনি গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সংবিধান রচনা করেন ফলে সংবিধান ব্যর্থ হয়।
২. শিক্ষা নীতি: আইয়ুব খানের ১৯৬২ সালের সংবিধান ব্যর্থতার অন্যতম কারণ ছিল শিক্ষা নীতি। আইয়ুব খান দ্বারা গঠিত শরীফ কমিশন শিক্ষা ক্ষেত্রে কয়েকটি নীতিমালা আরোপ করে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন হরণ, ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক, ধনীদের জন্য শিক্ষা, শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি প্রভৃতি কালা-কানুন করেন। এতে ছাত্র-সমাজ ক্ষিপ্ত হয়ে ১৯৬২ সালের সংবিধানের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে যার ফলে ১৯৬২ সালের সংবিধান ব্যর্থ হয়।
৩. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বাতিল: পাকিস্তান জন্ম হয় মূলত দুটি আলাদা ভূখণ্ডে একটি পূর্ব পাকিস্তান অন্যটি পশ্চিম পাকিস্তান। কিন্তু আইয়ুব ১৯৬২ এর সংবিধানে তার বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। কিন্তু দুটি আলাদা ভূখণ্ডে কখনোই এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র বা সংবিধান করা আকাশ-কুসুম চিন্তা ছাড়া কিছুই নয়। তাই তার অবাস্তব কল্পনার জন্য এ সংবিধান ব্যর্থ হয়।
৪. সর্বজনীন ভোটাধিকার বিলুপ্তি: ১৯৬২ সালের সংবিধান প্রণয়নে জনগণের মতের কোন প্রতিফলন হয়নি। অথচ বাঙালি জাতির দীর্ঘদিনের দাবি ছিল সর্বজনীন ভোটাধিকার। ১৯৫৪ সালে এ দাবি প্রতিষ্ঠা হলেও সামরিক আইন জারি ও ১৯৬২ সালের সংবিধানের মাধ্যমে তা খর্ব করা হয়। এ ছাড়া আইয়ুব খান প্রকাশ্যে এ সংবিধানে ভোটাধিকার ব্যবস্থা বাতিল করে ৮০,০০০ মৌলিক গণতন্ত্রীদের দ্বারা আইন পরিষদ গঠন করেছিল।
৫. সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র কায়েস: ১৯৬২ সালের সংবিধানে লিখিত দলিলে আইয়ুব স্বৈরতন্ত্রের ভিতিস্থাপন করা হয়। এ দৃষ্টান্ত ছিল সমকালীন পাকিস্তানের ইতিহাসে বিরল। তাই এ ধরনের সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হবে তা অমূলক ধারণা নয়। এ সত্যকে স্বীকার করে নিয়েই ৬২ সালের সংবিধানবিরোধী আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠে।
৬. মৌলিক অধিকার হরণ: ১৯৬২ সালে সংবিধানের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়। পাকিস্তান জন্মের ৯ বছর পর ১৯৫৬ সালের সংবিধানে মৌলিক অধিকারের কিছুটা নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারির পর আইয়ুব খান ৬২ সালে সংবিধানে মৌলিক অধিকার সংকুচিত করার কৌশল অবলম্বন করেন। ফলে পাকিস্তানের সচেতন জনগণ ১৯৬২ সালের সংবিধান বিরোধী আন্দোলনে শামিল হয়।
৭. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব: আইয়ুব খান ১৯৬২ সালের সংবিধান প্রণয়ন করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করে। এ বিচার বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণ তার নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ হওয়ায় জনগণের ব্যক্তিস্বাধীনতা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তাই ১৯৬২ সালের সংবিধান কার্যকরী হতে ব্যর্থ হয়।
৮. জনমতের উপেক্ষা: ১৯৬২ সালের সংবিধান প্রণয়নে জনগণের মতামত উপেক্ষা করা হয়েছে। ১৯৬২ সালের সংবিধান শরীফ কমিশনের মতামতের ভিত্তিতে রচিত হয়নি। এ সংবিধান আইয়ুব খানের মতামতের ভিত্তিতে রচিত হয়। যা ছিল মূলত আইয়ুব খান সংবিধান। তাই জনমতের উপেক্ষা করে সংবিধান স্থায়িত্ব লাভ করবে এ ধরনের পরিবেশ ছিল না।
৯. অর্থনৈতিক বৈষম্য: পাকিস্তানের দু’অঞ্চলের এক দশকের শাসনব্যবস্থা ছিল পাহাড়লম বৈষম্য। এ বৈষম্যের অবসান ঘটানোর কোন ইঙ্গিত ১৯৬২ সালের সংবিধানে ছিল না। তাই ১৯৬২ সালের সংবিধান ব্যর্থ হয়।
১০. এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা: যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় সাধারণত এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা হয় না। কিন্তু আইয়ুব খান ক্ষমতা এক হাতে রাখার জন্য এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠন করেন। ফলে কেন্দ্রেও প্রদেশে জনগণের ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়।
১১. মৌলিক গণতন্ত্র: আইয়ুব খান তার ইচ্ছা অনুযায়ী শাসনব্যবস্থা প্রচলিত করেন। তিনি আইনসভার সদস্যের জন্য গণপরিষদ গঠন না করে ৮০,০০০ মৌলিক গণতন্ত্রীদের নিয়ে মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা চালু করেন। এ শাসনব্যবস্থাকে ১. বিভাগীয় কাউন্সিল ২. জেলা কাউন্সিল; ৩. থানা কাউন্সিল; ৪. ইউনিয়ন কাউন্সিল গঠন করা হয় যার নেতৃত্ব দেয় আইয়ুব অনুগত ব্যক্তিরা।
১২. দমন নীতি: আইয়ুব খান রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করতেন না। তাই তিনি PODO ও EBDO গঠন করে জোরপূর্বক রাজনীতি না করার মুচলেকা নেন। সোহরাওয়ার্দী এতে মুচলেকা দিয়ে রাজনীতি ছেড়ে দেন। এ দমন নীতির জন্য ১৯৬২ এর সংবিধান ব্যর্থ হয়।
১৩. জাতীয়ভিত্তিক রাজনৈতিক দলের অভাব: ১৯৬২ সালের সংবিধান অনুযায়ী সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্তি করা হয়। এছাড়া মুসলিম লীগ বিভিন্ন স্বার্থ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। এতে বিরোধী দল মাথাচাড়া দেয় ও ১৯৬২ এর সংবিধান ব্যর্থ করে দেয়।
১৪. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা পরিধি: ১৯৬২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়। এতে রাষ্ট্রপতি ক্ষমতার মূল অংশ বিবেচিত হয়। এ সংবিধান অনুযায়ী মন্ত্রীরা পার্লামেন্টের পরিবর্তে রাষ্ট্রপতির কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকত। এতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা একেবারে বিনাশ হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রপতি হয়ে উঠে ক্ষমতার মধ্যমণি পক্ষান্তরে স্বৈরাচারী। এতে করে ১৯৬২ সালের সংবিধান ব্যর্থ হয়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৬২ সালের সংবিধান মূলত আইয়ুব খানের নিজের চিন্তা, ধারণা ও ব্যক্তিগত চরিত্র ফুটে উঠে। এতে তিনি ক্ষমতার সর্বেসর্বা হয়ে উঠেন। এতে করে জনগণ ধীরে ধীরে আন্দোলন গড়ে তোলেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬২ সালের সংবিধান বেশিদিন রান করতে পারেনি। মূলত স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাই ছিল এ সংবিধানের মূল লক্ষ্য। ফলে ১৯৬২ সালের সংবিধান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।