অথবা, ১৯৬২ সালের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।
উত্তরা। ভূমিকা: বাঙালি জাতির স্বায়ত্তশাসনের দাবি ছিল অনেক দিনের। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পরেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের উপর স্টিম রোলার চালায়। ১৯৫৮ সালে ইস্কান্দার মির্জা সামরিক শাসন জারি করেন। অবশেষে আইয়ুব খান ঐ বছরেই সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করে। আর ক্ষমতা স্থায়ী করার জন্য আইয়ুব খান ১৯৬২ সালে সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন।
১৯৬২ সালের সংবিধানের পটভূমি: আইয়ুব খান তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে বলেন, “১৯৫৪ সালে পাঁচতারা এক হোটেলের নির্জন কক্ষে তিনি নিজ রাষ্ট্র দখলের ছক আঁকেন।” রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের প্রতি আইয়ুব খানের শ্রদ্ধা ছিল না। এজন্য তিনি পাকিস্তানে দীর্ঘদিন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেন। POD এবং EBDO নামক দুটি আদেশ জারি করে শত শত রাজনীতিবিদকে নিষিদ্ধ করেন। একনায়কতান্ত্রিক শাসনের অপবাদ ঘুচানোর জন্য তিনি ১৯৬০ সালে তদানীন্তন বিচারপতি মোঃ শাহাবুদ্দিনকে সভাপতি করে একটি ‘সংবিধান’ কমিশন গঠন করেন। তথাপি সংবিধান কমিশনের রিপোর্ট অগ্রাহ্য করে আইয়ুব খান পাকিস্তানকে একটি উদ্ভট সংবিধান উপহার দেন। তিনি ১৯৫৬ সালের সংবিধানে প্রণীত সংসদীয় গণতন্ত্রসহ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও নাগরিক অধিকার বাতিল করেন। ‘মৌলিক গণতন্ত্র নামে এক অদ্ভুত ব্যবস্থা চালু করে সরকার নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে। আইয়ুব প্রবর্তিত সংবিধান সত্যিকার অর্থে রাষ্ট্রপতি স্বৈরশাসনের নীলনকশা ছিল। নিচে এ সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো:
১৯৬২ সালের সংবিধানের বৈশিষ্ট্যসমূহ: নিচে ১৯৬২ সালের সংবিধানের বৈশিষ্ট। আলোচনা করা হলো।
১. ইসলামি প্রজাতন্ত্র: আইয়ুব খানের সংবিধানে পাকিস্তানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করে। সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা হয় পাকিস্তান আইন পরিষদ কুরআন ও সুন্নাহ পরিপন্থি কোন আইন পাস করতে পারবে না। সংবিধানে ইসলামি আইন প্রণয়নের জন্য পরামর্শ দানের লক্ষ্যে আলেম সমাজ নিয়ে একটি পরামর্শ সভা বা কাউন্সিল গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়।
২. লিখিত সংবিধান: ১৯৬২ সালের সংবিধান ছিল লিখিত। এ সংবিধান ছিল বৃহত্তম সংবিধান। ১৯৬২ সালের
সংবিধান ১২টি অংশে বিভক্ত। এই সংবিধানে ২৫০টি ধারা ও ৩টি তফসিল ছিল।
৩. মৌলিক গণতন্ত্র: ১৯৬২ সালের সংবিধানে মৌলিক গণতন্ত্র নামে এক অভিনব ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। ভোটারগণ সরাসরি ভোট দিয়ে মৌলিক গণতন্ত্রীদের নির্বাচন করতেন। আর মৌলিক গণতন্ত্রীদের দ্বারা গঠিত নির্বাচকমণ্ডলী প্রেসিডেন্ট, জাতীয় পরিষদের সদস্য এবং প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নির্বাচিত করবে বলে বিধান রাখা হয়।
৪. যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা: এ সংবিধান পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান এ দু’প্রদেশের সমন্বয়ে পাকিস্তানের যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।
৫. এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা: ১৯৫৬ সালের সংবিধানের ন্যায় ১৯৬২ সালের সংবিধানেও কেন্দ্র ও প্রদেশে এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রবর্তন করা হয়। এ যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অনুকূল ছিল না।
৬. রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার: এ সংবিধানে পাকিস্তানে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। প্রেসিডেন্ট ছিলেন রাষ্ট্রের প্রকৃত শাসক। মন্ত্রিপরিষদ প্রেসিডেন্টের নিকট দায়ী ছিলেন।
৭. মৌলিক অধিকার: ১৯৬২ সালের সংবিধানে প্রথমত কোন মৌলিক অধিকারের কথা উল্লেখ করা হয়নি। পরবর্তীকালে দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে মৌলিক অধিকারের একটি তালিকা সংযুক্ত করা হয়।
৮. মূলনীতি: ১৯৬২ সালের সংবিধানে ২১টি নীতিনির্ধারকমূলক নীতিমালা সংযুক্ত ছিল। এগুলো আদর্শমাত্র কিন্তু আইনগত কোন ক্ষমতা ছিল না। সরকারের নীতিনির্ধারণে এগুলো আদর্শ হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
৯. কমিশন গঠন: কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রাদেশিক সরকারগুলোর মধ্যে রাজস্ব বণ্টনের সুপারিশ করার জন্য জাতীয় অর্থ-কমিশন ও দেশের সবোর্চ্চ অর্থনৈতিক পরিষদ গঠনের ব্যবস্থা এ সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়।
১০. আইন পরিষদের কেন্দ্র ঢাকা: এ সংবিধানে বলা ছিল, রাজধানীর ঢাকার এলাকা হবে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের কেন্দ্র এবং ইসলামাবাদ হবে সরকারের প্রধান কেন্দ্র। ১৯৬২ সালের সংবিধানে এ ধারা ছিল অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
১১. দুষ্পরিবর্তনীয়: ১৯৬২ সালের সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয় প্রকৃতির ছিল। এর পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধনের জন্য বিশেষ পদ্ধতির ব্যবস্থা ছিল। জাতীয় পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যদের সম্মতিসহ রাষ্ট্রপতির সম্মতিক্রমে সংবিধান সংশোধন করা যেত। এ সংবিধানে একটি প্রস্তাবনা সংযোজন করা হয়। এতে বলা হয়, সার্বভৌম ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর উপর অর্পিত হবে। তবে জনগণ এ ক্ষমতা পবিত্র আমানত হিসেবে ব্যবহার করবে।
১২. গণভোটের বিধান: এ সংবিধানে গণভোটের পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়। রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পরিষদ সদস্যদের মধ্যে কোন বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে বিষয়টি গণভোটের মাধ্যমে সমাধান করার বিধান রাখা হয়। এ সংবিধানে বাংলা ও উর্দু উভয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হয়।
১৩. কেন্দ্রীভূত শাসন: ১৯৬২ সালের সংবিধানের আওতায় রাষ্ট্রপতি, জাতীয় ও প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যবৃন্দ ৮০,০০০ মৌলিক গণতন্ত্রীদের দ্বারা নির্বাচিত হতেন, জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রিগণ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত ও তার মর্জির উপর নির্ভরশীল ছিলেন। কেন্দ্রীয় আইনসভা ছিল তাঁর আজ্ঞাবহ। প্রদেশের সরকারগণও রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হতেন। একমাত্র তার কাছে জবাবদিহি করতেন। এভাবে আইয়ুব প্রবর্তিত ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন ক্ষমতার মধ্যমণি। তাঁকে কেন্দ্র করে সবকিছু আবর্তিত-নিবর্তিত হয়েছে। ১৯৬২ সালের সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের অনেকটা মধ্যযুগের রাজার মতো ক্ষমতা ছিল।
১৪. রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার: ১৯৬২ সালের সংবিধানে আইয়ুব খান রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের প্রবর্তন করেন। এটা ১৯৬২ সালের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। রাষ্ট্রপতি সরকার ব্যবস্থায় প্রধান ক্ষমতা চর্চা করে রাষ্ট্রপতি। এখানে প্রধানমন্ত্রী নামেমাত্র ক্ষমতার অধিকারী। মূল ক্ষমতার চর্চা করে এখানে রাষ্ট্রপতি।
১৫. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব: ১৯৬২ সালের সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়। এটা ১৯৬২
সালের সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল।
১৬. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের অনুপস্থিতি: ১৯৫৬ সালের সংবিধানে লাহোর প্রস্তাবের আলোকে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন মেনে নেয়া হয়। কিন্তু আইয়ুব প্রবর্তিত সংবিধানে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন উপেক্ষিত ছিল। রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় আইনসভা যে কোন বিষয়ে আইন প্রণয়ন ক্ষমতা রাখত।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, সময়ের বিবর্তনে ভারত ও পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সংবিধান প্রণয়ন করতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। কারণ দুই পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘ মতপার্থক্য ছিল। ফলে ১৯৫৬ সালে প্রথম পাকিস্তানে সংবিধান রচিত হয়। অতঃপর ১৯৫৮ সালে ইস্কান্দার মির্জা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য সামরিক আইন জারি করে। পরবর্তীতে আইয়ুব খান ক্ষমতা গ্রহণ করে। অতঃপর তিনি ক্ষমতা স্থায়ী করার জন্য ১৯৬২ সালে আইয়ুবী সংবিধান প্রণয়ন করেন। কিন্তু গ্রহণযোগ্যতা না পাওয়ায় এ সংবিধান ব্যর্থ হয়।