আধুনিক রাষ্ট্রে নাগরিকের অধিকার আলোচনা কর।

অথবা, আধুনিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে নাগরিকের অধিকারসমূহ ব্যাখ্যা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: জীবনকে সুন্দরভাবে গঠন করে সুখী হওয়ার জন্যই মানুষ রাষ্ট্রের মধ্যে সংগঠিত হয় এবং রাষ্ট্রের আনুগত্য প্রদর্শন করে। মানুষ আশা করে যে, তাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও সুখসমৃদ্ধি সাধনে রাষ্ট্র উপযুক্ত সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করবে। বস্তুত মানুষের রাষ্ট্রনৈতিক জীবনের মূল উদ্দেশ্যই হলো অধিকার ভোগের মাধ্যমে সুস্থ, সুন্দর ও সুখী জীবন গড়ে তোলা। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে যেমন প্রত্যেক নাগরিক কিছু অধিকার ভোগ করে, তেমনি নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের অবশ্যই করণীয় কিছু কাজ আছে। রাষ্ট্র এসব কর্তব্যগুলো প্রত্যেক নাগরিকের নিকট প্রত্যাশা করে।

অধিকার: সাধারণ অর্থে, অধিকার বলতে কোন স্বত্ব বা দাবিকেই বুঝায় কিন্তু এ দাবি স্বীকৃত ও সংরক্ষিত না হলে অধিকারের সৃষ্টি হয় না। সমাজের মধ্যেই এর স্বীকৃতি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়। তাই অধিকার হলো একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক ধারণা।

আধুনিক রাষ্ট্রে নাগরিকের অধিকার: আধুনিক রাষ্ট্র কল্যাণমূলক রাষ্ট্র। গণতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থায় ক্রমপরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে আধুনিক রাষ্ট্রে নাগরিকের অধিকার বহুবিধ। আধুনিক রাষ্ট্রে নাগরিকের কর্তব্য পালনের মধ্য নিয়ে তাঁর অধিকার সুনিশ্চিত হয়। আর এভাবেই এগিয়ে চলে সমাজ। নিম্নে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নাগরিকের অধিকারসমূহ আলোচনা করা হলো:

১. সম্পত্তির অধিকার: মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য সম্পত্তির অধিকার একান্ত প্রয়োজন। সম্পত্তির অধিকার বলতে ব্যক্তিগত সম্পত্তি লাভের ও উপভোগের স্বাধীনতাকে বুঝায়। পুঁজিবাদী সমাজে সম্পত্তির অধিকার একটি মৌলিক অধিকার, যদিও সাম্যবাদী সমাজে এ অধিকার সীমিত। প্রত্যেক নাগরিক যাতে নিরাপদে এ অধিকার লাড করতে পারে তা দেখা প্রত্যেক রাষ্ট্রের কর্তব্য। জীবনধারণের অধিকার ব্যাহত হলে মানবজীবনের মৌলিক অধিকারের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। ফলে ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়।

২. জীবনধারণের অধিকার: নিজ জীবন রক্ষার অধিকার সকল অধিকারের ভিত্তি। প্রাণরক্ষার নিশ্চয়তা না থাকলে অন্যান্য অধিকারের কোন অর্থই থাকে না। তাই প্রত্যেক দেশে প্রত্যেক সরকার নাগরিকের জীবনধারণের অধিকারকে সুরক্ষিত রাখে। জীবনের নিরাপত্তা সুসভ্য জীবনযাপনের জন্য অপরিহার্য। বাঁচার অধিকার একটি মৌলিক অধিকার। এ কারণে নিজের জীবননাশ বা আত্মহত্যা বেআইনি। এ প্রসঙ্গে Human Rights Charter এ উল্লেখ আছে- “Every human being has the inherent right to life, this right shall be protected by law. No one shall be arbitrarily deprived of his life.”

৩. গতিবিধির অধিকার: গতিবিধির অধিকারও একটি মৌলিক অধিকার। এ অধিকারের অর্থ এই যে, প্রত্যেক নাগরিকের রাষ্ট্রের মধ্যে অবাধে চলাফেরার স্বাধীনতা আছে। কোন ব্যক্তি বা কোন সরকারি কর্মকর্তা যাতে নাগরিকের এ অধিকার খর্ব করতে না পারে তা দেখা রাষ্ট্রের কর্তব্য। তবে জরুরি পরিস্থিতিতে, যেমন- অভ্যন্তরীণ গোলযোগ ও যুদ্ধের সময়, রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে এ অধিকার খর্ব করা যেতে পারে। কিন্তু শান্তিকালে এর সংরক্ষণ একটি পবিত্র কর্তব্য। এ প্রসঙ্গে Human Right Charter এ উল্লেখ আছে “No one shall be subject to arbitrarily or detention.”

৪. ধর্মচর্চার অধিকার: ধর্মচর্চার অধিকার বলতে ব্যক্তির ইচ্ছামতো ধর্মাবলম্বন করার স্বাধীনতাকে বুঝায়। প্রত্যেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ অধিকার সংরক্ষণ করা হয়। রাষ্ট্র ধর্মকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কোন ব্যক্তি বা কর্মচারী যেন কারও ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত না করে তা দেখা রাষ্ট্রের কর্তব্য। অর্থাৎ প্রত্যেক ব্যক্তি যাতে স্বাধীনভাবে তার ধর্মচর্চা করতে পারে সেটা দেখা রাষ্ট্রের অবশ্য কর্তব্য।

৫. চুক্তি করার অধিকার: জিয়ার স্বাধীনতাকে বুঝায়। পুঁজিবাদী সমাজে এটি একটি মৌলিক অধিকার। এটি ছাড়া ব্যাক্তিগনের জন্য সংরক্ষিত হয় না। চুক্তির শর্ত পালন চুক্তিকারীর পক্ষে বাধ্যতামূলক। কেউ চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করলে ভাড়া আকি শান্তি প্রদান করবে। তবে এ অধিকারের একটি সীমারেখা আছে। সমাজের অকল্যাণমূলক কোন শর্তে কেউ কোন চুক্তি করলে রাষ্ট্র বৃহত্তর স্বার্থে তাকে বাধা দেবে। এ কারণে দাস ক্রয় বা সন্তান বিক্রয় বেআইনি।

৬. চিত্তা ও বিবেকের অধিকার: চিন্তা ও বিবেকের অধিকার ছাড়া কোন ব্যক্তির নৈতিক উন্নতি সম্ভব নয়। তাই প্রত্যেক নাগরিকের চিন্তার স্বাধীনতা, মতামত প্রকাশের অধিকার ও বিবেকের স্বাধীনতা থাকা উচিত। মতামতের ও চিন্তার স্বাধীনতা না থাকলে গণতন্ত্র মূল্যহীন হয়ে পড়ে। সরকারের সমালোচনার অধিকার, কোন নীতির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন এবং কোন নীতি বা পদ্ধতির বিরোধিতা করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকা উচিত। J. S. Mill বলেছেন, “মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করার অদ্ভুত কুফল এই যে, তা মানব গোষ্ঠীকে লুন্ঠন করে।”

৭. সংবাদপত্রের স্বাধীনতা: সংবাদপত্র মতামত ও চিন্তা প্রকাশের বাহনরূপ। সুতরাং চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার ফলস্বরূপ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা একান্ত প্রয়োজন। প্রত্যেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটি একটি মৌলিক অধিকার। গণতন্ত্রের ভিত্তি জনমত। কিন্তু সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছাড়া জনমত সুষ্ঠুরূপে সংগঠিত হতে পারে না। নাগরিকগণ সংবাদপত্রের মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা করলেও তা স্বীকৃত হওয়া প্রয়োজন এজন্য যে, সরকার তখন সমালোচনার ফলে ত্রুটিবিচ্যুতি দূর করতে পারে।

৮. পরিবার গঠনের অধিকার: পরিবার হলো সমাজের শাশ্বত রূপ। মানুষ মাত্রই কোন না কোন পরিবারে বাস করে। পরিবার গঠনের অধিকার বলতে আমরা নাগরিকদের বিবাহ করার, সন্তানের উপর অভিভাবকত্ব প্রতিষ্ঠার এবং উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি লাভের অধিকারকে বুঝি। প্রত্যেক রাষ্ট্রেরই কর্তব্য নাগরিকগণকে এ অধিকার দান করা এবং পারিবারিক জীবনের সুরক্ষা করা। এ প্রসঙ্গে Prof. MacIver বলেছেন, “Family is a group defined by a sex-relationship sufficiently precise and enduring to provide for the protection and up bringing of children.”

৯. সভাসমিতির অধিকার: গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সভাসমিতির অধিকারও একটি মৌলিক অধিকার। সমিতি গঠনের, সংঘবদ্ধ হওয়ার, জনসভা করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকা চাই। এ অধিকার প্রয়োগ করে নাগরিকগণ তাদের নীতি ও আদর্শ প্রচার করতে পারে, দল গঠন করতে পারে। কালক্রমে বৈধ উপায়ে সরকার গঠনের ক্ষমতাও লাভ করতে পারে। একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সভাসমিতির মাধ্যমে জনগণের মতামত প্রকাশ করার অধিকার খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে বিবেচ্য।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায় যে, নাগরিকগণ রাষ্ট্রের নিকট থেকে বহু অধিকার লাভকরে। অপরদিকে, তাদেরকে রাষ্ট্রের প্রতি বহু কর্তব্য পালন করতে হয়। বস্তুত অধিকার ও কর্তব্য সুখদুঃখের ন্যায় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। অধিকার ও কর্তব্য পরস্পর নির্ভরশীল এবং একে অন্যের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। প্রকৃতপক্ষে, আধুনিক রাষ্ট্রে একজনের অধিকার বললে অন্য জনের কর্তব্য বুঝা যাবে। “অধিকারের মধ্যে কর্তব্য নিহিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত উক্তি। আধুনিক রাষ্ট্রে তাই নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্য রাষ্ট্র কর্তৃক সুনির্ধারিত ও সংরক্ষিত হয়ে থাকে।