অথবা, আন্তর্জাতিকতাবাদের উপযোগিতা বর্ণনা কর।
উত্তর: ভূমিকা: আন্তর্জাতিকতাবাদ একটি বিস্তৃত ও ব্যাপক ধারণা বা মতবাদ। মূলত জাতীয়তাবাদের বৃহৎ পরিসরই হচ্ছে আন্তর্জাতিকতাবাদ। আন্তর্জাতিকতাবাদ আধুনিক বলে মনে হলেও এ ধারণা প্রাচীন গ্রিসে রাষ্ট্রচিভায় পাওয়া যায়। মধ্যযুগের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ দাঁন্তে তৎকালীন ইতালির অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা অবলোকন করে এক বিশ্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্বারোপ করেন। বর্তমানে আন্তর্জাতিকভাতাবাদের গুরুত্ব অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ আন্তর্জাতিকতাবাদের মাধ্যমে বিশ্বের বিবদমান রাষ্ট্রের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি গড়ে তোলা সম্ভব।
আন্তর্জাতিকতাবাদের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা বা উপযোগিতা: আন্তর্জাতিকতাবাদ একটি বিশ্বজনীন ধারণা। এর গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা বা উপযোগিতা অপরিসীম। নিয়ে আন্তর্জাতিকতাবাদের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তাসমূহ আলোচনা করা হলো:
১. উগ্র জাতীয়তাবোধের প্রতিক্রিয়া প্রতিরোধ: উন জাতীয়তাবাদের বিষবাষ্প থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকতাবাদ শুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সামন্ততান্ত্রিক যুগ অবসানের পর পুঁজিবাদী যুগ শুরু হয় এবং উন জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য ঔপনিবেশিকতার সৃষ্টি হয়। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে মানবসভ্যতা বিপর্যন্ত হয়। উগ্র জাতীয়তাবাদের এ সর্বনাশা গ্রাস থেকে পৃথিবীতে রক্ষা করতে আন্তর্জাতিকতাবাদ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
২. রাষ্ট্রের উন্নতি ও সমৃদ্ধি: রাষ্ট্রের শাস্তি ও সমৃদ্ধি পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আন্তর্জাতিকতাবাদের আদর্শ প্রসারিত হলে মারণাস্ত্র নির্মাণের প্রতিযোগিতা বন্ধ হবে এবং রাষ্ট্রের উন্নতি ও সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পাবে। কেননা প্রতিটি রাষ্ট্র তখন সমরাস্ত্র নির্মাণের বিপুল সামগ্রী ক্রয় করা থেকে বিরত থাকবে। সুতরাং একথা বলা যায়, আন্তর্জাতিকতাবাদ রাষ্ট্রের উন্নতি ও সমৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৩. বিশ্ব রাজনীতির সংকট প্রতিরোধ: আন্তর্জাতিকতাবাদের মাধ্যমে বিশ্ব রাজনীতির সংকট প্রতিরোধ করা সম্ভব। কেননা আন্তর্জাতিকতাবাদ এক রাষ্ট্রের সাথে অন্য রাষ্ট্রের সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি গড়ে তুলতে সর্বদা প্রচেষ্টা চালায়। কোন দেশের সরকার যাতে অন্য দেশের সরকারের উপর প্রভাব বা আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে সেজন্য আন্তর্জাতিকতাবাদ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
৪. সচেতনতা বৃদ্ধি: আন্তর্জাতিকতাবাদের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য হলো জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। উগ্র জাতীয়তাবাদ যে পৃথিবীর ধ্বংস ডেকে আনতে পারে এবং জনগণের শান্তি বিনষ্ট করতে পারে সে সম্পর্কে আন্ত র্জাতিকতাবাদ সচেতনতা প্রদান করে। যেমন- দু’টি বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ কাহিনী সম্পর্কে জনগণকে সচেতনতা জাগায়।
৫. সহযোগিতার পথ প্রশস্তকরণ; আন্তর্জাতিকতার মাধ্যমে পারস্পরিক সহযোগিতার পথ প্রশস্ত হয়। কেননা এক রাষ্ট্রের সাথে অন্য রাষ্ট্রের যাতে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি গড়ে উঠে আন্তর্জাতিকতাবাদ সে লক্ষ্যে কাজ করে। কারণ বর্তমান রাষ্ট্রগুলো পারস্পরিক সহযোগিতার উপর নির্ভরশীল।
৬. স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সহায়তা: আন্তর্জাতিকতাবাদ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমান বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য, চীন ও জাপানের অর্থনৈতিক উত্থান ইত্যাদি কারণে অনেক রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। এ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হচ্ছে আন্তর্জাতিকতাবাদ।
৭. বিশ্বশান্তি ও মানবসভ্যতা সংরক্ষণ: বিশ্বশান্তি ও মানবসভ্যতা সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিকতাবাদ অপরিহার্য। আধুনিক কালের পারমাণবিক যুদ্ধ সমগ্র বিশ্বকে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম। পারমাণবিক যুদ্ধের এ ভয়াবহ পরিণতি থেকে বিশ্বকে রক্ষা করার জন্য আন্তর্জাতিকতাবাদ শুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। তাই আন্তর্জাতিকতাবাদের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা সর্বদা স্বীকৃত।
৮. আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান: আন্তর্জাতিকতাবাদ কেবল শান্তি ও সম্প্রীতির বাণীই প্রচার করে না, সাথে সাথে বিশ্বের দ্বন্দ্ব কবলিত রাষ্ট্রসমূহের সমস্যার সমাধানও করে থাকে। আন্তর্জাতিকতাবাদের সম্প্রসারণের ফলেই মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার সমাধান কিছুটা হলেও সম্ভব হয়েছে। আন্তর্জাতিকতাবাদ আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধানের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বকে একটি সমাজের অন্তর্ভুক্ত করতে চায়।
৯. শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান: বর্তমান বিশ্বের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি অতীব জটিল ও ভয়াবহ। এর কারণ হলো বর্তমান বিশ্বে মার্কিন, যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য, জাপান ও চীনের অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ, কোরিয়ার উত্থান ইত্যাদি। আন্তর্জাতিকতাবাদ তাই এসব কিছুকে উপেক্ষা করে পৃথিবীর সমস্ত রাষ্ট্রকে একটি বিশ্ব সমাজের অন্তর্ভুক্ত করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের আশায় কাজ করে যাচ্ছে।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, বর্তমান বিশ্বে আন্তর্জাতিকতাবাদের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কেননা আন্তর্জাতিকতাবাদ সমগ্র বিশ্বের মানুষের মধ্যে শান্তি ও সমৃদ্ধি আনয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের ভূমিকা পালন করে থাকে। আন্তর্জাতিকতার মাধ্যমেই এক রাষ্ট্রের সাথে অপর রাষ্ট্রের সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি গড়ে তোলা সম্ভব, যা অন্য কোন উপায়ে সম্ভব হয় না। সুতরাং আন্তর্জাতিকতাবাদের গুরুত্বকে স্বীকার করে বিশ্বশান্তির লক্ষ্যে সকলকে কাজ করে যাওয়া অপরিহার্য।