আন্তর্জাতিক আইনের উৎসসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, আন্তর্জাতিক আইনের উৎসগুলো ব্যাখ্যা কর।

অথবা, আন্তর্জাতিক আইনের উৎস কী কী।

উত্তর: ভূমিকা: বর্তমান বিশ্বে কোন রাষ্ট্রই স্বয়ংসম্পূর্ণ বা আত্মনির্ভরশীল নয়। প্রতিটি রাষ্ট্রই অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি বহুবিধ পারস্পরিক সম্পর্ক ও সহযোগিতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। তাই প্রয়োজন এমন কতকগুলো নিয়মকানুনের সমষ্টি, যেগুলো বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ করবে। সুতরাং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তি ও শৃঙ্খলার স্বার্থে আন্তর্জাতিক আইনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। এ আন্তর্জাতিক আইন বিভিন্ন উৎস থেকে সৃষ্টি হয়।

আন্তর্জাতিক আইনের উৎসসমূহ: আন্তর্জাতিক আইনের উৎস প্রসঙ্গে আইনবিদদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্যও রয়েছে। কারণ আন্তর্জাতিক আইন কোন দেশের আইনসভা কর্তৃক রচিত হয় না। আন্তর্জাতিক আইনের উৎস সম্পর্কে গেটেল (Gettell) প্রধান তিনটি উৎসের কথা বলেছেন। এগুলো হলো: ১. চিরাচরিত প্রথা, ২. যুক্তি এবং ৩. সম্মতি। নিম্নে উৎস তিনটির কর্ণনা দেয়া হলো:

১. চিরাচরিত প্রথা: বিভিন্ন রাষ্ট্র পারস্পরিক কাজকর্মের জন্য কতকগুলো প্রথা বা আচার মেনে চলে। কোন রাষ্ট্র যদি কোন প্রথার মাধ্যমে আদর্শ স্থাপন করে তা হলে অন্য রাষ্ট্রও সে প্রথা অনুসরণ করে একটি বিশেষ প্রথার সৃষ্টি করে। এসব প্রথা পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়।

২. যুক্তি: যুক্তি বা বিচার বিবেচনা আন্তর্জাতিক আইন গঠনে সাহায্য করে। বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপে প্রচলিত পদ্ধতিসমূহকে ভিত্তি করে এবং বিচার বিবেচনার ফলে নতুন নতুন নিয়মাবলি রচনা করে রাষ্ট্রসমূহ তাদের আন্তর্জাতিক কর্মপথে নিয়ম ও শৃঙ্খলা স্থাপন করেছে।

৩. সম্মতি: সম্মতিই এ আইনের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। যুদ্ধের সময় এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের সাথে বিভিন্ন সন্ধি করে। ভবিষ্যতে তা অন্য রাষ্ট্রের জন্য আদর্শ সৃষ্টি করে এবং নতুন নতুন নিয়ম তৈরি করে। আন্তর্জাতিক আদালতের বিধান (Statute) এর ৩৮ ধারা অনুসারে আন্তর্জাতিক আইনের উৎসসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো:

১. আন্তর্জাতিক চুক্তি: বিবদমান রাষ্ট্রসমূহ কর্তৃক স্বীকৃত এবং সাধারণ বা বিশেষ আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট নিয়মাবলি।

২. আন্তর্জাতিক প্রথা: আন্তর্জাতিক প্রধাসমূহ যা আইনের মতে বাধ্যতামূলকভাবে স্বীকৃত।

৩. রাষ্ট্রসমূহ কর্তৃক স্বীকৃত সাধারণ নিয়ম: আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম প্রধান উৎস হলো সভ্য রাষ্ট্রসমূহ দ্বারা স্বীকৃত আইনের সাধারণ নিয়মসমূহ।

৪. আইনবিদদের পাণ্ডিত্যপূর্ণ রচনা: বিশিষ্ট আইনবিদদের বিভিন্ন পান্ডিত্যপূর্ণ রচনা আন্তর্জাতিক আইনের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

৫. আদালতের সিদ্ধান্ত: বিভিন্ন দেশের আদালতের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এবং আন্তর্জাতিক আদালতের সিদ্ধান্তসমূহকে আন্তর্জাতিক আইনের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

৬. রাষ্ট্রপ্রধান ও কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের মতামত: আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের মতামতও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রথা ও রীতিনীতি সৃষ্টিতে এবং আন্তর্জাতিক আইন তৈরিতে সাহায্য করে থাকে।

৭. আতিসংঘের উদ্যোগ: বর্তমানে আন্তর্জাতিক আইনের উৎস হিসেবে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ বা জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়নের উদ্যোগ আয়োজনকে স্বীকার করা হয়।

৮. রোমান আইন: প্রাচীন রোমে বিদেশি ও বিভিন্ন জাতির সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য যে আইন প্রণয়ন করা হয় তা আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।

৯. আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার সিদ্ধান্ত: বিভিন্ন আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (Regional Co-operative Organization) যেমন- EU, ASEAN, SAARC, Regional Bloc এর গৃহীত সিদ্ধান্ত এবং সাধারণ নিয়মসমূহ থেকে আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়নে সাহায্য নেয়া হয়। এভাবে এগুলো আন্তর্জাতিক আইনের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

১০. আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আহ্বান: বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক, বহুপাক্ষিক বা আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধানকল্পে যেসব আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহ্বান করা হয়, সেসব সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনেক সময় আন্তর্জাতিক আইনের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, বিভিন্ন উৎস থেকে উৎসারিত আন্তর্জাতিক আইন বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা রাষ্ট্রসমূহ আন্তর্জাতিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং নিজ রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে মান্য করে থাকে। বস্তুত পৃথিবীর সকল শান্তিকামী মানুষ এ আশা পোষণ করে যে, আন্তর্জাতিক আইন যথাযথভাবে আইনের ভূমিকা পালন করে বিশ্বশান্তি বজায় রাখতে সক্ষম হবে। কেননা আন্তর্জাতিক আইনের পিছনে রয়েছে বিশ্বজনমত অর্থাৎ জাতিসংঘ। বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে আন্তর্জাতিক আইন মান্য করা উচিত।