আল্লামা ইকবালের জগৎ সম্পর্কিত মতবাদ ব্যাখ্যা কর।

অথবা, জগৎ সম্পর্কে আল্লামা ইকবালের মতবাদ ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ কর।

অথবা, আল্লামা ইকবালের জগৎ সম্পর্কিত মতবাদ আলোচনা কর।

অথবা, জগৎ সম্পর্কে ইকবালের মতবাদ বর্ণনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে আল্লামা ইকবাল বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। তিনি মুসলিম দর্শনে প্রাচ্যের আধ্যাত্মিক ও পাশ্চাত্যের বস্তুবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছেন। তিনি পাশ্চত্যের সেসব দিক গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন, যেগুলো ইসলামের মূল শিক্ষার পরিপন্থি ছিল না। ইসলামি শিক্ষার যে দৃষ্টিভঙ্গি তা পুনর্জাগরণে তার অবদান অপরিসীম। তাই অনেক চিন্তাবিদ মনে করেন আল-গাজালির পর যদি এমন কোন চিন্তাবিদ থেকে থাকেন যিনি মুসলিম দর্শনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি হলেন আল্লামা মোহাম্মদ ইকবাল।

ইকবালের জগৎ সম্পর্কিত মতবাদ: জগৎ বলতে বুঝায় বাহ্য জগৎ। সাধারণত দেখা যায় যে, যারা অধ্যাত্মবাদ কিংবা স্বজ্ঞাবাদের কথা বলেছেন তারা সাধারণত বাহ্য জগতের কথাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। কিন্তু আল্লামা ইকবাল জ্ঞানের উৎস হিসেবে স্বজ্ঞাকে স্বীকার করলেও এবং খুদীকে তার দর্শনে বিশেষ স্থান দিলেও তিনি জগতের বাস্তব অস্তিত্বকে স্বীকার করেছেন।

জগৎ ও বাস্তব: ইকবাল বহির্জগতের অস্তিত্বকে বাস্তব বলেছেন। তিনি বলেছেন জগৎ কোন মায়া বা ভ্রান্ত প্রত্যক্ষন নয় কিংবা এটি অবাস্তব কল্পনাও নয়, বরং এটি অস্তিত্বশীল এবং বাস্তব। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের বাস্তব জীবনের ক্ষেত্রে বিষয় ও বিষয়ের অস্তিত্বকে অনুভব করি। অর্থাৎ, জ্ঞানের ক্ষেত্রে সচেতনতার দ্বারা প্রতিটি ক্ষেত্রে জ্ঞাতা এবং জেয়ের দ্বৈততা অনুভব করে। মানুষ মাত্রই তার জীবনে এ দ্বৈততা বা বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। তবে জগৎকে জানার জন্য ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণ বা বুদ্ধি যথেষ্ট নয়, বরং একমাত্র স্বজ্ঞার মাধ্যমেই জগতের বাস্তব অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায়। আমরা জানি যে, পাশ্চাত্যে দর্শনের শুরু হয়েছে যেলিসের পানি দর্শন বা জড়বাদী ভাবধারা হতে। গ্রিক দার্শনিকরা জগৎকে দেখেছেন নিশ্চল জড় হিসেবে। কিন্তু ইকবালের সাথে প্রাচীন গ্রিক চিন্তার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হলো এ যে, গ্রিকরা বাস্তব জগৎকে বললেও একে জানার উপায় হিসেবে বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণকে আদর্শ হিসেবে ধরে নিয়েছেন। কিন্তু ইকবাল জগৎকে বাস্তব বললেও একে সঠিকভাবে জানার পদ্ধতি হিসেবে স্বজ্ঞার কথা বলেছেন।

জগৎ প্রাণপ্রবাহ: পূর্বেই বলা হয়েছে যে, গ্রিক জড়বাদীরা জগৎকে যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন। তারা এর মধ্যে কোন প্রাণের চিহ্ন দেখেন না। কিন্তু ইকবাল বলেছেন, জগৎ নিশ্চল জড় নয়, বরং এটি একটি প্রবহমান অনুক্রম, যেখানে রয়েছে প্রাণের প্রবহমানতা। মূলত একে যদি আমরা বুদ্ধি বা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জানতে চাই, তাহলে সেটি সম্ভব হয় না। তাই একে জানতে হলে প্রয়োজন স্বজ্ঞাগত অভিজ্ঞতা। তিনি বলেছেন, মানুষের মধ্যে প্রাণপ্রবাহের প্রতিনিয়ত প্রকাশ হচ্ছে। এর মূলে যে বিষয়টি কাজ করছে, সেটি হলো ইচ্ছা। মানুষের বেঁচে থাকার ইচ্ছা প্রকাশিত হচ্ছে জগতের ক্রিয়ার মাধ্যমে। অন্যান্য প্রাণী যেখানে বেঁচে থেকে সন্তুষ্ট হয় কিংবা শুধু বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করে সেখানে মানুষ প্রতিনিয়ত ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য নতুন নতুন কৌশল আয়ত্ত করতে চেষ্টা করে। ইকবাল তার খুদী দর্শনে দেখিয়েছেন যে, খুদী বা অহমকে উত্তরোত্তর বিকশিত করা। তাই ইকবালের মতে “যা ব্যক্তিত্বকে শতিশালী করে তা ভালো আর যা ব্যক্তিত্বকে দুর্বল করে তা মন্দ”।

আল্লাহ জগৎকে সৃষ্টি করেছেন পরিপূর্ণ ও নিখুঁতভাবে। বাস্তবসত্তা সংগঠনশীল এবং সে সত্তা সম্পর্কিত সত্যকে ও সত্তার নতুন প্রকাশের সাথে অবশ্যই সংগতিপূর্ণ হতে হবে। ইকবাল বিশ্বাস করেন যে, বাস্তব সত্তা সম্পর্কিত এ গতিশীল মত কুরআনের শিক্ষার সাথে বিরোধের সৃষ্টি করে না, বরং কুরআনিক শিক্ষার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আল কুরআনে জগৎকে বন্ধ্যা বলা হয় নি, বরং একে বর্ণনা করা হয়েছে বর্ধনশীল ও বিকাশমান সত্তা হিসেবে। জগৎ গতিশীল, প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অভিব্যক্তিতে জগৎ পরিবর্তিত হচ্ছে।

উদ্দেশ্যবাদ: ইকবাল জগৎকে বাস্তব বলেছেন যেমন সত্য, তেমনি এটি যে বিবর্তন মাধ্যমে বিকশিত হচ্ছে সেটিও সত্য। তবে এ বিবর্তন যান্ত্রিক নয়। এটি একটি বিশেষ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বাস্তবায়নে এগিয়ে চলেছে, তা বাইরে থেকে আরোপিত নয়, বরং এটি জগতের মূল বৈশিষ্ট্যর মধ্যে গ্রথিত। উদ্দেশ্যর প্রকৃতি সম্পর্কে তিনি আরও বলেছেন, উদ্দেশ্য কোন দূরবর্তী কোন লক্ষ্য নয়। জগৎ নিয়ত পরিবর্তনশীল ও বর্ধনশীল। জগৎ প্রক্রিয়ার পিছনে আছে প্রজ্ঞা এবং পরিকল্পনা। আল্লাহ এ জগৎকে সৃষ্টি করেছেন নিজেকে প্রকাশ করার জন্য। মানুষের উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর হুকুম ও আহকাম সম্পর্কে অবহিত হওয়া এবং সে সম্পর্কে আল্লাহর ইবাদত করা। ইকবাল বলেছেন, জগতে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, জগতে আমাদের উদ্দেশ্য কেবল আধ্যাত্মিক উন্নতি নয়, ইহজাগতিক উন্নতি। জীবনের প্রক্রিয়া যেমন বিকশিত হতে থাকে ও প্রসারিত হতে থাকে, তেমনি নতুন নতুন উদ্দেশ্যও নানাবিধ মূল্যমান নিয়ে প্রসারিত হতে থাকে। আর
এজন্য আমরা জগতে সার্বিক নিয়ম বা শৃঙ্খলা দেখতে পাই। মানুষের চালিকাশক্তি যেমন উদ্দেশ্য, তেমনি এ জগতের বা প্রকৃতিরও রয়েছে একটি উদ্দেশ্য। ইকবাল জগৎকে কেবল জড় বলে মনে করেন না, বস্তু জগৎ অজীব অণুর সম্মিলন নয়, বরং সজীব অস্তিত্বশীল কণা দিয়েই সবকিছু সৃষ্টি। ইকবাল মনে করেন যে, বিশ্বের সৃষ্টি ও চরম উদ্দেশ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং বিশ্বের সব অস্তিত্বেরই গতি প্রকৃত নির্দিষ্ট। ইকবালের ভাষায়,

“এ বিশ্ব হয়তো আজ ও অসমাপ্ত যেন আজ ও শোনা যায় আদের্শ হও’আর জন্ম লাভ করে তা “

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায় যে, আল্লামা ইকবাল জগৎ বলতে পরিবর্তনশীল বা গতিশীল জড় জগতকে নির্দেশ করেছেন, যা ক্রমবর্ধমান বা ক্রমবিকাশমান প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে পরিপূর্ণ করার মাধ্যমে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে ধাবিত হচ্ছে। তাঁর মতে, সজ্ঞার মাধ্যমে এ বাস্তব জগতকে জানা যায়। সজ্ঞার সাথে খুদী বা অহং সম্পর্কিত। অর্থাৎ, খুদীকে জাগ্রত করতে পারলেই সজ্ঞার মাধ্যমে সরাসরি জ্ঞান লাভ করা যায়। ইকবালের মতে, এ জগতের পিছনে বয়েছেন মহান আল্লাহ। আল্লামা ইকবালের জগৎ সম্পর্কে এরূপ ব্যাখ্যা মুসলিম দর্শনকে সমৃদ্ধ করেছে।