অথবা, আল গাজলি আল্লাহর একত্ব প্রমাণে দার্শনিকদের যুক্তির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উত্থাপন করেন তা আলোচনা কর।
অথবা, আল্লাহর একত্ব প্রমাণে দার্শনিকগণ কিরূপ মতবাদ দেন? এ প্রসঙ্গে আল গাজালি কী অভিযোগ এনেছেন?
অথবা, আল-গাজালি আল্লাহর একত্ব প্রমাণে দার্শনিকদের যুক্তির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উত্থাপন করেন তা ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।
উত্তর: ভূমিকা: মুসলিম জাহানের এক চরম সংকটময় মুহূর্তে আল গাজালির আবির্ভাব। তিনি একাধারে কবি, দার্শনিক, লেখক ও ধর্মীয় চিন্তানায়ক ছিলেন। তিনি সবসময় লেখনীর মাধ্যমে সত্য বিষয়গুলো প্রচার করতেন। অসত্য বিষয়কে তিনি প্রশ্রয় দিতেন না। আল্লাহর একত্ব প্রমাণের বিষয়টি ধর্মতাত্ত্বিক সম্প্রদায়ের মুসলিম চিন্তাবিদদের থেকেই লক্ষ্য করা যায়। মুতাজিলা সম্প্রদায়ের চিন্তাবিদগণ প্রথম আল্লাহর একত্ব প্রমাণ করার জন্য আগ্রহী ছিলেন।
আল্লাহর একত্ব প্রমাণে দার্শনিকদের যুক্তি: আল্লাহর একত্ব প্রমাণ করার জন্য দার্শনিকরা যেসব যুক্তি দেখিয়েছেন আল গাজালি তাকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। যথা:
প্রথম যুক্তি: দার্শনিকরা মনে করেন, আল্লাহ যদি একাধিক হয় তাহলে সেটা অবশ্যই সত্তার জাতি বুঝাবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। আর তখন এটার সব কয়টির উপর জাতিবাচক নাম প্রযোজ্য হবে। আর সৃষ্টিকর্তার মর্যাদা কখনো অন্য কোনকিছুর উপর প্রযোজ্য হবে না। উদাহরণস্বরূপ: মানুষ বলতে যায়েদ, আমর প্রভৃতি বিশেষ ব্যক্তিকে বুঝায় না। একমাত্র যায়েদই মানুষ নয়। তাই যদি হতো তাহলে আমরও মানুষ থাকতো না। প্রত্যেকটি মানুষকেই এক একটি কারণ দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। সুতরাং সত্তা অবশ্যম্ভাবী অবশ্যই হতে হবে।
দ্বিতীয় যুক্তি: দার্শনিকদের মতে, অবশ্যম্ভাবী সত্তা যদি দুটি হয় তাহলে তা সম্পর্কিত হতে পারে নিম্নলিখিতভাবে।
যথা:
১. সর্বদিক থেকে হয় তারা পরস্পর সমান হবে নয়তো।
২. সর্বদিক থেকে একে অপরের বিপরীতে হবে।
আল গাজালির অভিযোগ: দার্শনিকদের উপরের দু’ধরনের যুক্তিকে ইমাম আল গাজালি ভুল বলে মনে করেন। তিনি বলেন, এসব যুক্তির মাধ্যমে কখন্যে আল্লাহর একত্ব প্রমাণ করা যায় না। আল গাজালি দার্শনিকদের এ যুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন।
প্রথম যুক্তির প্রতিবাদ: দার্শনিকদের প্রথম যুক্তির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উত্থাপন করেন তা নিম্নে আলোচনা করা হলো:
প্রথমত, দার্শনিকদের মতে, সত্তা একাধিক হলে তা একটি অবশ্যম্ভাবী জাতি বুঝাবে। কিন্তু গাজালি মনে করেন, দার্শনিকদের এটা একটা ভুল ধারণা। তাঁর অবশ্যম্ভাবী ধারণার মধ্যে জটিলতা রয়েছে। সত্তা দুটি যদি কারণ ব্যতীত থাকে এবং একটি অপরটির কারণ না হয় তাহলে কোন দোষত্রুটির ধারণা করা উচিত নয়।
দ্বিতীয়ত, গাজালির মতে, অবশ্যম্ভাবী সত্তার কোন কারণ নেই, একথা যখন দার্শনিকরা বলেন তখন সেটা নেতিবাচক বক্তব্য হয়ে যায়। এ রকম নেতিবাচক বক্তব্য কখনো ইতিবাচক বক্তব্যের জন্য পর্যাপ্ত নয়।
তৃতীয়ত, গাজালির মতে, অবশ্যম্ভাবী যদি একটি স্থির ও ইতিবাচক বক্তব্য ধরে নেয়া হয় তাহলে তাও বোধগম্য নয়। গাজালি বলেন, সত্তার কারণ অস্বীকার করা নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক।
চতুর্থত, আল গাজালির মতে, কৃষ্ণতা একটি রং। এ কথা দ্বারা এটা বুঝায় না যে, অন্য কিছু এ গুণ ত্যাগ করে। গাজালি বলেন, দার্শনিকদের এ সমস্ত যুক্তি কখনো আল্লাহকে একক সত্তা বলে মনে করতে পারেন না।
দ্বিতীয় যুক্তির প্রতিবাদ: আল্লাহর একত্ব প্রমাণের জন্য গাজালি দার্শনিকদের দ্বিতীয় যুক্তিকেও ভুল বলে মনে করেন।
নিম্নে এ যুক্তির প্রতিবাদ আলোচনা করা হলো:
১. দার্শনিকদের সাথে গাজালি একমত পোষণ করেন যে, বৈসাদৃশ্য ছাড়া কোনকিছুর দ্বিত্ব ভাবা যায় না। সমস্ত দিক থেকে দুটি সত্তার মধ্যে কোন বৈসাদৃশ্য থাকতে পারে না।
২. গাজালির মতে, দার্শনিকদের প্রথম কারণ ব্যাখ্যাকারী শব্দ ও সংখ্যা দ্বারা বিশ্লেষিত হয় না। তাদের একত্ববাদের ভিত্তি এ মতবাদের উপরই প্রতিষ্ঠিত। দার্শনিকদের মতে, আল্লাহর একত্ব সর্বতোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় না। পাঁচ প্রকার সত্তার উপর বহুত্ব আরোপিত হয়। যেমন-
প্রথমত, যে সত্তা বিভাজ্য হবে সেই সত্তার উপর বহুত্ব আরোপিত হতে পারে। এটা প্রথম কারণের উপর এটা সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়ত, যে বস্তু সংখ্যা দ্বারা বিভক্ত না হয়ে কল্পনা দুটি ভাব দ্বারা বিভক্ত হয় সে বস্তুর উপর বহুত্ব আরোপিত হয়।
তৃতীয়ত, ইচ্ছা, শক্তি, জ্ঞান প্রভৃতি দ্বারা বহুত্ব সৃষ্টি হতে পারে। যেমন প্রাণীত্ব আবশ্যিকভাবে বা যুক্তিগতভাবে মনুষ্যত্ব নয়। কারণ সমস্ত প্রাণীই মানুষ নয়। মানুষ বাকশক্তি সম্পন্ন প্রাণী। প্রাণী হচ্ছে জাতি আর বাকশক্তি সম্পন্ন গুণটি হলো শ্রেণী নিরূপক বিশেষণ।
চতুর্থত, ইচ্ছা, শক্তি, জ্ঞান প্রভৃতি দ্বারা বহুত্ব সৃষ্টি হতে পারে। কেননা এগুলোর অস্তিত্ব অবশ্যম্ভাবী হয় যদি সমস্ত বিশেষণ অবশ্যম্ভাবী হয়।
পঞ্চমত, বস্তুর প্রকৃতির অস্তিত্ব কল্পনা ও প্রকৃতির কল্পনার মাঝে বহুত্ব সৃষ্টি হতে পারে। যেমন- এটার প্রকৃতি মানুষের অস্তিত্বের আগেই বর্তমান ছিল।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, আল্লাহর একত্ব সম্পর্কে গাজালি যে যুক্তি দিয়েছেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস করেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে, আল্লাহ এক, এতে কোন সন্দেহ নেই। যে ভাবে দার্শনিকরা আল্লাহর একত্ব প্রমাণ করতে চেয়েছেন, সেভাবে আল্লাহর একত্ব প্রমাণিত হয় না এবং মুসলমানদের পক্ষে এভাবে প্রমাণ করতে যাওয়া ঠিকও নয়।