অথবা, আল্লাহর গুণাবলি সম্পর্কে আল গাজালির ধারণা কী?
অথবা, আল্লাহর গুণাবলি সম্পর্কে আল গাজ্জালির মতবাদ বিস্তারিত লেখ।
অথবা, আল্লাহর গুণাবলি সম্পর্কে আল গাজালির মতবাদ বর্ণনা কর।
অথবা, আল্লাহর গুণাবলি সম্পর্কে আল গাজালির মতবাদ ব্যাখ্যা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: ইসলামি চিন্তার জগতে আল গাজালি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে মৌলিক চিন্তাবিদ। তিনি জ্ঞানের গভীরতায় ছিলেন উজ্জ্বল নক্ষত্র। আল্লাহর কোন গুণ আছে কি না এ নিয়ে মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। একমাত্র মুতাজিলা সম্প্রদায় ব্যতীত সকল সম্প্রদায় ও সাধারণ মুসলমানরা আল্লাহর গুণে বিশ্বাস করেন। মুতাজিলাদের মতো ফালাসিফা সম্প্রদায়ের দার্শনিকরাও আল্লাহর গুণাবলি স্বীকার করেন নি। তারা আল্লাহর গুণাবলিকে রূপক বলে মনে করেন। কিন্তু গাজালির মতে, আল্লাহর গুণাবলি অবশ্যই আছে।
আল্লাহর গুণাবলি সম্পর্কে মুতাজিলা সম্প্রদায়ের যুক্তি: আল্লাহর একত্ব ও ন্যায়পরায়ণতার ধারক হচ্ছে মুতাজিলা সম্প্রদায়। আল্লাহর একত্ব ও ন্যায়পরায়ণতা রক্ষা করা হলো মুতাজিলা সম্প্রদায়ের প্রধান উদ্দেশ্য। তাদের মতে, সৃষ্টিকর্তার উপর যদি অধিকতর গুণ আরোপ করা হয় তাহলে তাদের ন্যায়পরায়ণতা বিনষ্ট হবে। তাই তারা পরম করুণাময়ের গুণকে অস্বীকার করেন। মুতাজিলারা বলেন, পরম করুণাময়ের গুণাবলি পরিবর্তনশীল অথবা চিরস্থায়ী হবে। যদি পরম করুণাময়ের গুণ পরিবর্তন হয় তাহলে খোদা স্বয়ং পরিবর্তন হয়ে যায়। কিন্তু খোদাকে কখনো পরিবর্তন করা যাবে না। আর সৃষ্টিকর্তা যদি চিরস্থায়ী হয় তাহলে বহু সত্তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যাবে না। যদি অস্বীকার করা হয় তাহলে খোদার ন্যায়পরায়নতা বিনষ্ট হয়ে যাবে।
আল গাজালির খণ্ডন: মুতাজিলারা সৃষ্টিকর্তার গুণ সম্পর্কে যে আলোচনা করেছেন আল গাজালি সেগুলোকে গ্রহণ করেন নি রবং পরিবর্জন করেছেন। তিনি মুতাজিলা সম্প্রদায়ের মতবাদকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে খণ্ডন করেছেন। মুতাজিলারা খোদার গুণাবলি চিরন্তন বা পরিবর্তনশীল বলেছেন। কিন্তু গাজালি বলেন, খোদা চিরস্থায়ী, তার কোন পরিবর্তন নেই।’
আল্লাহর গুণাবলি সম্পর্কে দার্শনিকদের প্রথম যুক্তি: দার্শনিকদের মতে, সৃষ্টিকর্তা নিজে এবং তার গুণাবলি এ দুয়ের মধ্যে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। এ সম্পর্কের ক্ষেত্রে দার্শনিকরা তিনটি কথা উল্লেখ করেন, যার কোন না কোনটি এর সাথে সম্পর্কিত। যথা:
১. এদের একটির অস্তিত্ব অপরটির অস্তিত্বের সম্মুখীন হবে না।
২. এদের একটির অস্তিত্ব অপরটির অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল হবে বা সম্মুখীন হবে।
৩. এদের একটির অস্তিত্ব অপরটির অস্তিত্বের সম্মুখীন হবে এবং একটির অস্তিত্ব অপরটির অস্তিত্বের সম্মুখীন হবে না।
দার্শনিকদের উপর্যুক্ত তিনটি বিকল্পের কোনটিই একত্রিতভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
আল গাজালির খণ্ডন: গাজালি দার্শনিকদের প্রথম যুক্তি নিম্নলিখিতভাবে খণ্ডন করেছেন:
প্রথমত, গাজালির মতে, দার্শনিকরা অবশ্যম্ভাবী সত্তাকে যুক্তিসংগতভাবে পমাণ করতে পারেন নি। তারা শুধু প্রমাণ করেছেন কিভাবে ফল ও কারণের অনুগম বন্ধ করা যায়।
দ্বিতীয়ত, গাজালি দার্শনিকদের যুক্তি খণ্ডন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে উল্লেখ করেন। জগতের যাবতীয় বস্তুর অন্তি ত্ব যদি কারণের অনুরূপ হয় এবং যদি একটি কারণ অন্য একটি কারণের অনুরূপ হয় তাহলে অশেষ অনুগম অবশ্যই ঘটবে। এটা খণ্ডন করে গাজালি বলেন, বিশেষণ কখনো সত্তা থেকে আলাদা করা যায় না, সত্তার মধ্যেই বিশেষণ নিহিত।
তৃতীয়ত, গাজালির মতে, দার্শনিকরা যে দ্বৈতসত্তা নিয়ে আলোচনা করেন তা হলো শর্তহীন দ্বৈতসত্তা। দার্শনিকরা কখনো এ দ্বৈতসত্তা বর্জন করতে পারবে না। গাজালি বলেন, এ সমস্যা সমাধানের জন্য কোন কার্যকরী প্রমাণ নেই। আছে কিছু নেতিবাচক প্রমাণ।
চতুর্থত, গাজালির মতে, দার্শনিকরা অবশ্যম্ভাবী সত্তা বলতে বুঝান যার কোন কার্যকরী কারণ নেই। অনন্ত সত্তার যেমন কোন কারণ নেই, তেমনি বিশেষণ অনন্ত, এর কোন কার্যকরী কারণ নেই।
দার্শনিকদের দ্বিতীয় যুক্তি : মানবীয় গুণাবলির কিছু আকস্মিক গুণ রয়েছে। যেমন- জ্ঞান, শক্তি ইত্যাদি। এ গুণগুলো আমাদের সত্তার অন্তর্ভুক্ত নয়। এ গুণগুলো ব্যক্তি জীবনের কোন এক সময় আমাদের উপর আরোপ করা হয়। দার্শনিকরা বলেন, এসব গুণাবলি যখন খোদার উপর আরোপ করা হয় তখন এ গুণাবলি তাঁর প্রকৃতির অন্তর্ভুক্ত নয়। সুতরাং এগুলো আবশ্যিক।
আল গাজালির খণ্ডন: আল গাজালি দার্শনিকদের দ্বিতীয় যুক্তি নিম্নলিখিতভাবে খণ্ডন করেন। যথা:
১. আল গাজালি দার্শনিকদের শব্দ প্রয়োগের অদক্ষতার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দেন। দার্শনিকরা কিছু গুরুগম্ভীর আলোচনা করেছন, যা অর্থহীন। এটা বলেই আমাদের ভীতির মধ্যে ফেলে দিয়েছেন।
২. দার্শনিকরা বলেন, কিছুসংখ্যক গুণ আরোপ করলে আল্লাহ অভাবী হয়ে যাবে। গাজালি বলেন, একথা ঠিক যে, যাবতীয় গঠনই গঠনকারীর অভাবী। যাবতীয় সৃষ্ট বস্তুই সৃষ্টিকর্তার অভাবী। সুতরাং সৃষ্টিকর্তা কারণহীন অনাদি।
৩. পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালাকে দার্শনিকরা তাঁর গুণাবলির কারণ বলে উল্লেখ করেন। গাজালি এসব কথা সম্পূর্ণরূপে পরিহার করেন। তিনি বলেন, সৃষ্টিকর্তা কখনো তাঁর নিজস্ব গুণের কারণ হতে পারেন না। আল্লাহ যেমন অসীম, তেমনি তাঁর গুণাবলিও অসীম।
মূল্যায়ন: আল্লাহর গুণাবলি নিয়ে দার্শনিক মহলে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে। তাই হাদিসে বলা হয়েছে, “তোমরা আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হও।” দার্শনিকরা আল্লাহর গুণাবলিকে অস্বীকার করেন। মুতাজিলা সম্প্রদায়ও খোদার গুণাবলিকে স্বীকার করেন না। সুতরাং গাজালি আল্লাহর গুণাবলিকে স্বীকার করেন এবং বলেন, আল্লাহ অনাদি ও অনন্ত।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, আল্লাহর গুণ প্রসঙ্গে ইমাম আল গাজালি যেসব যুক্তি দিয়েছেন তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেন, আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তার কোন শরিক নেই। দার্শনিকরা আল্লাহর গুণাবলি সম্পর্কে যা ‘বলেছেন গাজালি তা খণ্ডন করেছেন। তিনি শরিয়ত অনুযায়ী আল্লাহর গুণাবলি স্বীকার করেছেন। সুতরাং মুসলমান হিসেবে সবাইকে আল্লাহর গুণাবলি স্বীকার করা উচিত।