আল গাজালির কার্যতত্ত্ব আলোচনা কর। হিউমের সাথে তার মতের পার্থক্য দেখাও।

অথবা, আল গাজালির কার্যকারণ তত্ত্ব, আলোচনা কর। হিউমের সাথে তার মতের
বিশ্লেষণ কর।

অথবা, আল গাজালির কার্যকারণতত্ত্ব ব্যাখ্যা কর। হিউম্মে সাথে তাঁর মতের পার্থক্য তুলনামূলক আলোচনা কর।

অথবা, আল গাজারির কার্যকারণতত্ব বর্ণনা কর। হিউমের সাথে তার মতের পার্থক্য আলোচনা কর।

উত্তর: ভূমিকা: মুসলিম চিন্তা জগতের একজন সর্বশ্রেষ্ঠ মৌলিক চিন্তাবিদ ছিলেন ইমাম আল গাজালি। মুসলিম দর্শনের চরম যুগসন্ধিক্ষণে তাঁর আবির্ভাব ঘটে। রাজনৈতিক, দার্শনিক ও ধর্মীয় দিক থেকে মুসলমানরা যখন এক সংকটময় অবস্থার মধ্যে বিরাজ করেছিল ঠিক তখনই আল গাজ্যলি তার সত্যবাদী ও লেখনী শক্তি দিয়ে সেগুলো দূর করেন। তিনি ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী, অসাধারণ মেধাবী ব্যক্তিত্বের অধিকারী। সুনিশ্চিত সত্য আবিষ্কারের জন্য তিনি অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা অতিক্রম করেছেন। তিনি একাধারে কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, সমাজসংস্কারকও ছিলেন। তিনি কার্যকারণ নিয়মকে আবশ্যিক নিয়ম বলে মানতে রাজী নন। তিনি দার্শনিকদের মতবাদ খণ্ডন করার জন্য বদ্ধপরিকর।

আল গাজালির কার্যকারণ তত্ত্ব: কার্যকরণতত্ত্বের বর্ণনা ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে আল গাজালি ছিলেন তার সময়ের চেয়ে অগ্রগামী। মূলত তিনি দার্শনিকদের সমালোচনার একটি বিশেষ দিক হিসেবে কার্যকারণ সম্পর্ককে অস্বীকার করেন। তাঁর মতে, দার্শনিকগণ এ নিয়মকে একটি বিশেষ নিয়ম হিসেবে দেখান। বস্তুত এ নিয়মকে বিশ্লেষণ করলে এর অসারতা আমাদের সামনে ধরা পড়ে। তিনি মনে করেন যে, কার্যকারণের দু’টি দিক থাকতে পারে। প্রথমত, কার্যকারণের সম্পর্ক আবশ্যিক বা অনিবার্য। অন্যদিকে, দ্বিতীয়টি হলো এই যে, প্রতিটি কার্যের একটি কারণ এবং প্রতিটি কারণের একটি কার্য থাকবে। আল গাজালি এ দুটি দিককে চ্যালেঞ্জ করে এর অসারতা প্রমাণ করেন।

কার্যকারণ আবশ্যিক নয়: কার্যকারণকে দার্শনিকরা আবশ্যিক বলে মনে করেছেন। কিন্তু গাজালি দেখান যে, বস্তুত এদের মধ্যে কোন আবশ্যিক সম্পর্ক নেই। যেমন- ধরা যাক আগুন ও দাহিকা শক্তির সম্পর্ক কিংবা পানি ও পিপাসা নিবৃত্তির সম্পর্ক। তাঁর মতে, এদের মধ্যে এমন কোন অনিবার্যতা লক্ষ্য করি না। এদের একটির অস্তিত্ব অপরটির অস্তি ত্বকে অনিবার্যভাবে প্রতিষ্ঠা করে না। আমরা এতে ভাবতে পারি যে, আগুন আছে ঠিকই। কিন্তু সে আগুন দহন করে না। এ ধরনের ঘটনা না ঘটলেও চিন্তার ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনার কোন স্ববিরোধিতা নেই।

কার্যকরণের আবশ্যিকতা মনে করার কারণ: গাজালি বলেছেন, প্রাকৃতিক জগতে আমরা যখন কার্যকারণকে বারবার পূর্বাপর ঘটতে দেখি, তখন নিতান্তই অভ্যাসবশত আমরা তাদের অভিজ্ঞতার জগৎ থেকে চিন্তার জগতে স্থানান্তরিত করে ফেলি এবং এদের পূর্বাপর সম্বন্ধের ব্যাপারে অনিবার্যতা অনুভব করি। এ অভ্যাস পাই কোন প্রকৃত অনিবার্যতার কারণে নয়, বরং দুটি ঘটনার বার বার পূর্বাপর ঘটনার জন্য। বস্তুত এ সম্বন্ধ বাহ্যিকভাবে অনুপস্থিত। তবে তা আমাদের মনের মধ্যে রয়েছে। অর্থাৎ কার্য ও কারণের যে অনিবার্যতা দার্শনিকরা দেখেছেন, তা বস্তুগত অনিবার্যতা নয়, বরং মনস্তাত্ত্বিক অনিবার্যতা। আমাদের মনের বাইরে বা মন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত অনিবার্যতার বাইরে কার্য ও কারণের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোন অভ্যন্তরীণ অনিবার্যতা নেই। কারণ ও কার্যকে পূর্বাপর সংঘটিত হতে দেখা গেছে বটে ‘কিন্তু কার্য যে প্রকৃতই কারণ দ্বারা সংঘটিত হয়েছে, তা কখনো প্রত্যক্ষিত হয় নি। মূলত কারণ যে কার্যের পূর্বগামী তাতে সন্দেহ নেই, তবে তা যে কার্যের স্রষ্টা তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

প্রাকৃতিক বস্তু কোন কারণ নয়: গাজালির মতে, কোন প্রাকৃতিক বস্তু এমন কি নভোমণ্ডলের কোন সত্তাও প্রকৃত কারণ হতে পারে না। কেননা এরা সবাই নিষ্প্রাণ ও নির্জীব। তবে আল্লাহ সর্বশক্তিমান এবং তিনি প্রাকৃতিক কার্যকারণের অনিবার্যতার অধীনে নন। কোন নিষ্প্রাণ বস্তু কোন ঘটনা সৃষ্টি করতে পারে না। তাই তিনি দৃঢ়ভাবে এ মত পোষণ করেন যে, আল্লাহই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডসহ যাবতীয় বস্তুর সৃষ্টিকর্তা ও আদি কারণ। আল্লাহর ইচ্ছায় সবকিছু সৃষ্টি হয়েছে। আর তাই তিনিই একমাত্র সবকিছুর কারণ।

একটি কার্যের একটি কারণ যথার্থ সয়: দার্শনিকরা বলেন, প্রতিটি কার্যের একটি কারণ থাকবে। এ ধারণা সম্পর্কে আল গাজালি সন্দেহ প্রকাশ করেন। তিনি মনে করেন যে, প্লাটিনাসের ‘Theory of Emanation’ (বিকিরণবাদ) এর প্রতি অতিশয় আকর্ষণের ফলে তারা হয়ত এ ভুলটি করেছেন। কারণ এটি কোন এককধর্মী ঘটনা নয়। এটি এমন একটি মিশ্র জিনিস যার পিছনে কিছু নঞর্থক শর্ত কাজ করে। কোন বস্তুর পিছনে একাধিক কারণের জটিল সংমিশ্রণ কাজ করে। যেমন- আমাদের দৃষ্টিশক্তি, আলো, বায়ু, আবহাওয়া, দূরত্ব, অবস্থান এসবের উপর নির্ভরশীল। তাই বলা যায় যে, আমরা যদি কোন একক কারণকে কোন কার্যের পিছনে দেখি, তাহলে তা যথার্থ হয় না।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, আল গাজালির দার্শনিক পদ্ধতি ছিল বিজ্ঞানভিত্তিক। শুধু তাই নয় তার দর্শন ছিল প্রজ্ঞা ও বুদ্ধির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। আর একারণেই বিশ্ব ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তিনি বলেন, চরম সত্যের জ্ঞানভিত্তিক প্রমাণ বা যুক্তিভিত্তিক প্রমাণ সম্ভব নয়। হিউমের বহুপূর্বে গাজালি কার্যকারণের আবশ্যিকতাকে যৌক্তিক অসার বলে প্রমাণ করেছেন। শুধু গাজালির কার্যকারণ সম্পর্কিত আলোচনা তার আধুনিক মানবের পরিচায়ক।