অথবা, আল ফারাবির নীতিদর্শন আলোচনা কর।
অথবা, আল-ফারাবি নীতিদর্শনে কিরূপ মতবাদ প্রদান করেন?
অথবা, আল-ফারাবির নীতিদর্শন ব্যাখ্যা কর।
অথবা, আল-ফারাবির নীতিদর্শন বিশ্লেষণ কর।
উত্তর: ভূমিকা: মুসলিম দার্শনিক ঐতিহ্যে আল ফারাবি একটি অবিস্মরণীয় নাম। তিনি জ্ঞানানুশীলনের জন্য বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করেন। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। ম্যাকডোনাল্ড তাঁর Development of Muslim Theology’ গ্রন্থে আল ফারাবি সম্পর্কে বলেছেন, তিনি মুসলিম দর্শনের পিরামিডের মূল ভিত্তি। শুধু তাই নয়, দার্শনিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে তিনি যে স্তরে উন্নীত হয়েছিলেন, অন্য কোন মুসলিম দার্শনিক সে স্তরে পৌঁছাতে পারেন নি। তাঁর সমগ্র দার্শনিক প্রচেষ্টা প্লেটো, এরিস্টটল ও সুফিবাদের এক চিন্তাকর্ষক সমন্বয়ে রচিত। বলা হয়ে থাকে, ইবনে সিনা যে উঁচু মানের দার্শনিকের কৃতিত্ব অর্জন করতে পেরেছিলেন তার মূলে ছিল আল ফারাবির সমগ্র অধ্যয়ন এবং সঠিক অনুকরণ।
আল ফারাবির নীতিদর্শন: নীতিদর্শন আমাদের ঐচ্ছিক আচরণের ন্যায়, অন্যায়, ভালো, মন্দ, উচিত, অনুচিত ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে। দর্শনের একটি শাখা হিসেবে নীতিবিদ্যার আলোচনা দর্শনের ইতিহাসের মতো পুরোনো। ফারাবি ইসলামের মূল শিক্ষার সাথে বুদ্ধিবাদের সমন্বয়ের মাধ্যমে তাঁর নীতিদর্শন উপস্থাপন করেন। নিম্নে তার নীতিদর্শন আলোচনা করা হলো:
১. প্রজ্ঞাই নৈতিক মানদণ্ড: আল ফারাবি দ্ব্যর্থহীনভাবে এবং দৃঢ়তার সাথে স্বীকার করেন না যে, প্রজ্ঞাই হলো নৈতিক মানদণ্ড। অর্থাৎ প্রজ্ঞার মাধ্যমেই কোনটি ভালো কোনটি মন্দ তা নির্ধারিত হয়। তাঁর মতে, নৈতিক ধারণাবলি সম্পর্কিত বিষয়ের জ্ঞানকে উচ্চ মর্যাদা দেয়া উচিত। তাঁর মতে, ঐ ব্যক্তি উত্তম, যে জেনে শুনে এবং অনুধাবন করে নৈতিক নিয়ম পালন করে। তাঁর মতে, যুক্তিবিদ্যা যেমন আমাদের চিন্তার বৈধতা বা আকার নিয়ে আলোচনা করে। তেমনি নীতিবিদ্যা আমাদের আচরণের ঔচিত্য ও অনৌচিত্য সম্পর্কে কোন আদর্শ অনুসরণ করা উচিত না আলোচনা করে। ফারাবির মতে, ‘এ আদর্শ হলো প্রজা”।
২. নৈতিক জীবনের লক্ষ্য শাস্তি: আল ফারাবির মতে, “নৈতিক জীবনের মূল বিষয় হলো আমাদের জীবন শান্তিময় করে তোলা।” শান্তি শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Peace. এটি মনের এমন একটি আনন্দদায়ক বা সুখকর অবস্থা, যা সৎ ও মহৎ কাজের পরিণতি হিসেবে আমাদের মনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসে। তিনি শান্তি শব্দটিকে শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্যের সাথে সংযুক্ত করেন। এর মাধ্যমে তাঁর নীতিবিদ্যা সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারতার প্রমাণ মেলে। মানুষ তার কাজের একটি সুন্দর ফল আশা করে। আর এ শুভ ফল হলো শাস্তি। ফারাবির মতে, “মানুষের চরম ও পরম লক্ষ্য হচ্ছে শান্তি অর্জন।” মুহাম্মদ শাহজাহান তাঁর ‘আল-ফারাবির নীতিবিদ্যা’ প্রবন্ধে বলেছেন, “শান্তি হচ্ছে সর্বোত্তম শুভ এবং সর্বোত্তম পরিপূর্ণতা শান্তি স্বয়ংসম্পূর্ণ, বিনা বিচারেই শুভ। এটি জীবনের চরম ও পরম উদ্দেশ্য, কিন্তু উদ্দেশ্য সাধনের উপায় নয়।”
৩. সৎগুণ অর্জনের মাধ্যমে শান্তি লাভ: আল ফারাবির মতে, “মানুষ সৎগুণের মাধ্যমে শান্তি লাভ করে।” ব্যক্তির কার্যাবলি যথোচিত হলে সে সুনাম অর্জন করে এবং যথোচিত না হলে সে দুর্নামের অংশীদার হয়। শুভ বুদ্ধির মাধ্যমে ব্যক্তি সত্যের অনুসরণ তথা ভ্রান্তি থেকে দূরে থাকতে পারে। অপরদিকে অশুভ বুদ্ধি তাকে ভ্রান্তির পথে পরিচালিত করে। আমরা যদি ক্রমাগতভাবে শুভ বুদ্ধিকে সঠিক পথে চালিত করতে পারি, তাহলে ব্যক্তি হিসেবে আমরা প্রকৃত শান্তি অর্জন করতে পারব।
৪. সৎ গুণ অর্জন: আল ফারাবির মতে, “ভে বুদ্ধির সাহায্যে প্রকৃত শান্তি অর্জনের অভ্যাসই হচ্ছে সৎগুণ।” অন্যকথায় সৎগুণ হচ্ছে আত্মার এমন এক অবস্থা, যার দ্বারা মানুষ ভালো করতে সমর্থ হয়। মানুষের পক্ষে শান্তি অর্জনের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে ফারাবি বলেছেন, “আমাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনে শাস্তি অর্জন সম্ভব।” তবে শাস্তি প্রাপ্তির মধ্যে অবশ্যই তারতম্য রয়েছে গুণগত ও পরিমাণগত দিক দিয়ে। তাঁর মতে, “আল্লাহর প্রেরিত পুরুষগণ এবং দার্শনিকগণ সত্যিকার অর্থে শান্তি অর্জনে সক্ষম। দার্শনিক ও নবীদের অজ্ঞাত হলে সাধারণ মানুষও শাস্তি অর্জন করতে পারে।”
মন্তব্য: আল ফারাবির নৈতিক দর্শন সৎ গুণের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। সৎ গুণের মাধ্যমে মানুষ শান্তি লাভকরে। ব্যক্তির কাজ ভালো হলে সে সুনাম অর্জন করে। আর ব্যক্তির কাজ মন্দ হলে সে সুনাম অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। নীতিবিদ্যা আমাদের আচরণের ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত, ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদি বিষয় আলোচনা করে। সৎগুণে সমৃদ্ধশালী ব্যক্তিবর্গই পার্থিব ও পরজগতে শাস্তি লাভে সমর্থ হয়। প্লেটোকে অনুসরণ করে তিনি এমন মন্তব্যও করেন যে, সৎ গুণসম্পন্ন মহান ব্যক্তিবর্গ পরজগতে শান্তি পাবেন।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, আল ফারাবি ছিলেন একজন বুদ্ধিবাদী মুসলিম দার্শনিক। তাঁকে প্রাচ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম দার্শনিক বলা হয়ে থাকে। পরবর্তী দার্শনিকদের উপর প্রভাব ছিল গভীর। দর্শনের বিভিন্ন শাখায় তার ছিল অসাধারণ পাণ্ডিত্য। আর এ জন্য তিনি ‘মুয়াল্লিম সানী’ উপাধীতে ভূষিত হয়েছিলেন। তাঁর দর্শন দ্বারা প্লেটো ও এরিস্টটল প্রভাবিত হলেও নৈতিক ও রাজনৈতিক মতবাদে তিনি ইসলামের আদর্শ থেকে কখনো বিচ্যুত হন নি। নীতিবিদ্যায় তাঁর ধ্যান ধারণা তাঁর পরবর্তী দার্শনিকদের মধ্যে এক বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং মুসলিম দর্শনের ক্রমোন্নতির সাথে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তিনি গ্রিক নীতিবিদ্যাও অধ্যয়ন করেন।