আল-ফারাবির নীতিবিদ্যায় গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের প্রভাব আলোচনা কর।

অথবা, নীতিবিদ্যার আলোচনায় ফারাবি কিভাবে এরিস্টটল কর্তৃক প্রভাবিত হয়েছে?

অথবা, আল-ফারাবির নীতিবিদ্যায় গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের বিরূপ প্রভাব রয়েছে বিশ্লেষণ কর।

অথবা, আল-ফারাবির নীতিবিদ্যায় গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের প্রভাব বর্ণনা কর।

অথবা, আল-ফারাবির নীতিবিদ্যা কিভাবে গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের দ্বারা প্রভাবিত ব্যাখ্যা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: মুহাম্মদ আল-ফারাবি ইসলামি চিন্তার ইতিহাসে একজন খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব। তিনি নীতিবিদ্যা বিষয়ক কোন গ্রন্থ রচনা করেন নি। তিনি শুধু এরিস্টটলের নিকোমেকিয়ান ইথিকস এর ভাষ্য রচনা করেছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে সে গ্রন্থেরও কোন সন্ধান মেলে নি। এম. এ. এইচ আনসারী বলেন, ফারাবি শুধু এরিস্টটলের নিকোমেকিয়ান ইথিকস এর ভাষ্য রচনা করেছেন, অন্য কোন গ্রন্থ রচনা করেন নি। জর্জ, এফ, হাওয়ানি বলেন, আল-ফারাবি নীতিবিদ্যার উপর বেশিকিছু লিখেন নি। মূলত নীতিবিদ্যা বিষয়ক বিচ্ছিন্ন ধারণা তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে বিচ্ছিন্নভাবে রয়েছে। সুতরাং নীতিবিদ্যা বিষয়ক বিচ্ছিন্ন ধারণাগুলো একত্রিত করে সুবিন্যস্তভাবে সাজালে তাঁর এক দর্শনের একটি রূপরেখা দাঁড় করানো যেতে পারে।

ফারাবির নীতিবিদ্যা: শাস্তি অর্জন হল তাঁর নীতিবিদ্যার মূল বিষয়। আল-ফারাবি শান্তি বুঝাতে আরবি শব্দ সা’আদাহ ব্যবহার করেছেন। পরকালের শান্তির পরিপ্রেক্ষিতে পবিত্র কুরআনেও উক্ত শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আত্মার বৃত্তিকে তিনি পাঁচ ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা:

ক. উদ্ভিদাত্মক আত্মা (Nutrative soul),

খ. সংবেদনাত্মক আত্মা (Sensative soul),

গ. কল্পনাত্মক আত্মা (Imaginative soul),

ঘ. কামনাত্মক আত্মা (Appetitive soul) এবং

ঙ. বৌদ্ধিক আত্মা (Rational soul)।

ফারাবি শাস্তি অর্জনের উপায় সম্পর্কে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে মানুষের কার্যাবলি, মনোবৃতি ও বৃদ্ধিবৃত্তির প্রয়োগ সম্পর্কে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি সদৃওণকেও পাঁচ ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা।

১. তাত্ত্বিক সম্পূণ (Theoretical virtue),

২. নৈতিক সদ্‌গুণ (Moral virture),

৩ বৌদ্ধিক সমৃত (Intellectual virtue),

৪. চিন্তামূলক সমৃণ (Reflective virtue) এবং

৫. ব্যবহারিক সদৃশ (Practical virtue)।

তিনি মনে করেন জনসাধারণকে নৈতিকতা সম্পর্কে আহিত করা দার্শনিক ও রাসূলদের কর্তব্য। আর জনসাধারণের কর্তব্য হল তাঁদের প্রদর্শিত পথ অনুযায়ী নিজেদের জীবন গড়ে তোলা।

ফারাবির নীতিবিদ্যায় এরিস্টটলের প্রভাব: মুসলিম নীতিবদ্যা দুই ভাগে বিভক্ত। যথা:

১. আদর্শনিষ্ঠ ধর্মীয় নীতিবিদ্যা এবং

২. যুক্তিভিত্তিক বিশ্লেষণাত্মক নীতিবিদ্যা।

১. আদর্শনিষ্ঠ ধর্মীয় নীতিবিদ্যা: এ নীতিবিদ্যায় ধর্মীয় বিধানের নৈতিক নীতিমালা কুরআন ও হাদিসের আলোকে
শরিয়তভিত্তিক বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে।

২. যুক্তিভিত্তিক বিশ্লেষণাত্মক নীতিবিদ্যা: এখানে কুরআন ও হাদিসের মৌলিক নীতি অক্ষুন্ন রেখে আদর্শনিষ্ঠ নীতিবিদ্যার মূলতত্ত্ব জ্ঞানের উদ্দেশ্য সাধনের উপায় ও মূল্যবোধ সম্পর্কে বিচারমূলক বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে।

গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের বিশ্লেষণাত্মক নীতিবিদ্যার উপর প্রভাব রয়েছে। ফারাবির নীতিবিদ্যা বিচারমূলক বিশ্লেষণাত্মক নীতিবিদ্যা। মুসলিম দার্শনিক আল-কিন্দি, ইবনে সিনা, ইখওয়ানুস সাফা, ইবনে রুশদ ও মুতাজিলা সম্প্রদায়ের দার্শনিকেরা নীতিবিদ্যা এ শাখার অন্তর্ভুক্ত।

ফারাবি একজন বুদ্ধিবাদী মুসলিম দার্শনিক। তিনি এরিস্টটলের দর্শন সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণে বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। তিনি এরিস্টটলের নিকোমেকিয়ান ইথিকস অধ্যয়ন করেছেন এবং তার ভাষাও রচনা করেছেন। সুতরাং ফারাবির দার্শনিক চিন্তাধারার রূপরেখায় এরিস্টটলের নৈতিক দর্শনের সূত্রগুলো কিছুটা প্রভাব বিস্তার করবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। শান্তির ধারণা, শাস্তি অর্জনের উপায়, সদ্‌গুণ, মধ্যপন্থা প্রভৃতি বিষয়বস্তুর বর্ণনা ও বিশ্লেষণ থেকেও অনুমান করা যায় যে, ফারাবির নৈতিক দর্শনে এরিস্টটলের প্রভাব রয়েছে। এটা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, ফারাবি ব্যক্তিজীবনে একজন খাঁটি মুসলমান ছিলেন। সুতরাং তাঁর দর্শনে ইসলামের নীতিমালার সুস্পষ্ট প্রভাব থাকা স্বাভাবিক। সদ্‌গুণ, শান্তি অর্জন এবং সদ্‌গুণ অর্জনের জন্য মধ্যপন্থা অবলম্বন ইত্যাদি ইসলাম ধর্মের নীতিমালা ও এরিস্টটলের দর্শন এবং ইসলামি জীবনদর্শন উভয় ক্ষেত্রেই পরিলক্ষিত হয়। ফারাবি যেভাবে শাস্তি অর্জনের পন্থা উপস্থাপন করেছেন তা আপাতদৃষ্টিতে এরিস্টটলের দর্শনের মত। তবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তা ইসলামি ভাবধারা ও চেতনায় সমৃদ্ধ। তাঁর লিখিত গ্রন্থাবলি আলোচনা করলে উক্ত বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায়।

ফারাবি দর্শন চর্চার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন, “যে মহান আল্লাহ সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা ও মূল কারণ তাঁর পরিচয় লাভদর্শন চর্চার উদ্দেশ্য। মানুষের পক্ষে যতটুকু সম্ভব, খোদার গুণাবলি অনুকরণ, অনুশীলনের মাধ্যমে সুন্দর চরিত্র গঠন করা দার্শনিকদের কর্তব্য।”
ফারাবির দর্শনের অন্যতম লক্ষ্য হল, ইসলামি চিন্তাধারা ও মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটানো। ফারাবি এরিস্টটলের দর্শন চর্চা করেছেন সত্যি, তবে তার ভিত্তিতে আমরা এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি না যে, এরিস্টটলের চিন্তাধারা ছিল ফারাবির নীতিবিদ্যার মূলভিত্তি।

মূল্যায়ন: আল-ফারাবি আদর্শনিষ্ঠ, বিশ্লেষণধর্মী, উদ্দেশ্যমূলক মানবতাবাদী ও নীতিবিদ্যার প্রবক্তা। যদিও মনে করা হয় যে, ফারাবির নৈতিক চিন্তাধারা এরিস্টটল কর্তৃক বিশেষভাবে প্রভাবিত, কিন্তু তাঁর নৈতিক চিন্তাধারা এরিস্টটলে নীতিবিজ্ঞানের চর্বিতচর্ষণ নয়, বরং সেটা তাঁর স্বকীয় চিন্তার ফল। ফারাবি বুদ্ধিদীপ্ত অভিজ্ঞতাপ্রসূত ধ্যানধারণার আলোকে ইসলামি নীতিমালার মৌলিকত্ব অক্ষুন্ন রেখে গ্রিক চিন্তাধারার ও ইসলামি ভাবধারার প্রেক্ষাপটে যুক্তিভিত্তিক আদর্শমূলক নীতিবিদ্যার উন্নতি সাধন করেছেন। নৈতিক বিচারে তিনি ইচ্ছার স্বাধীনতার উপরও গুরুত্ব দিয়েছেন।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, আল-ফারাবির নীতিবিদ্যায় এরিস্টটলের প্রভাব থাকলেও মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর নীতিবিদ্যায় একথা প্রমাণিত হয় যে, মধ্যযুগেও ধর্মভিত্তিক নীতিবিদ্যা ছাড়াও দার্শনিক বিশ্লেষণমূলক নীতিবিদ্যা প্রচলিত ছিল। তাছাড়া এ মধ্যযুগ গ্রিক চিন্তাধারার ধারাবাহিকতা ও উৎকর্ষের সাক্ষ্য বহন করে, যা প্রাচীন যুগের সাথে বর্তমান যুগের মিলনসূত্র হিসেবে কাজ করেছে।