অথবা, বিশ্বতত্ত্ব সম্পর্কে আল-ফারাবির মতবাদ সংক্ষেপে লিখ।
অথবা, বিশ্বতত্ত্ব সম্পর্কে আল-ফারাবির মতবাদ সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বিশ্বতত্ত্ব সম্পর্কে আল-ফারাবি কী বলেন?
অথবা, আল-ফারাবির বিশ্বতত্ত্ব কিরূপ?
উত্তর: ভূমিকা: বিশ্বতত্ত্ব প্রসঙ্গে আল-ফারাবির দৃষ্টিভঙ্গি মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বতত্ত্বের ধারা হিসেবে খোদার সাথে সৃষ্টিজগতের সম্পর্ক নির্ধারণ ও অপরিবর্তনশীল সত্তার সাথে পরিবর্তনশীল জগতের সামঞ্জস্য বিধানের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি বিশ্বতত্ত্বের আলোচনা করতে গিয়ে অনেকটা আল-কিন্দির মতোই নব্য প্লেটোবাদীদের বিকিরণবাদ (Emanation) এর শরণাপন্ন হয়েছেন। পরম আদিসতা আল্লাহ থেকে তিনি বিভিন্ন বস্তুর বিকিরণের যে বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন, তা আমাদের বিশেষত নব্য প্লেটোবাদী দার্শনিক প্রাক্লাসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
আল-ফারাবির বিশ্বতত্ত্ব: আল-ফারাবি মনে করেন, জগৎ আল্লাহর সরাসরি সৃষ্টি নয়, বরং কতিপয় মধ্যবর্তী শক্তির মাধ্যমে বিকীর্ণ। যে সত্তারাজি আল্লাহ তাঁর অপরিমেয়তা ও পূর্ণতার কল্যানে সৃষ্টি করেন, সেগুলোর সবই প্রকৃতিয় অনিবার্যতার ফল, এমন ফল যা সম্পূর্ণরূপে তার নির্বাচন ও ইচ্ছামুক্ত। পরমসত্তার পূর্ণতায় জগৎ নতুন কিছুই সংযোজন করে না এবং তাঁকে উদ্দেশ্যবাদী দিক থেকে নিয়ন্ত্রণও করে না। প্রকৃতপক্ষে জগৎপ্রক্রিয়া স্রষ্টার এক ধরনের স্বতঃস্ফূর্ত কর্মবিশেষ। আবার স্রষ্টা এ সৃষ্টি বা বিবিকরণ প্রক্রিয়ায় এমন কোন মাধ্যম বা হাতিয়ারের প্রয়োজন বোধ করেন না, যার সাহায্যে তাঁর সৃষ্ট কর্মের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। অন্যদিকে, এমন কোন বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ অন্তরায়ও নেই, যা এ চিরস্থায়ী সৃষ্টিপ্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারে। পরম আদি সত্তা থেকে সর্বপ্রথম বিকীর্ণ সত্তা হচ্ছে আদি বুদ্ধি। আদি বৃদ্ধি তার স্রষ্টা ও নিজের সম্পর্কে উপলব্ধি করতে পারে।
আদি বুদ্ধির এ উপলব্ধি ক্রিয়া থেকে সৃষ্ট হয়েছে দ্বিতীয় বুদ্ধি, আর দ্বিতীয় বুদ্ধির উপলব্ধি ক্রিয়া থেকে সৃষ্ট হয়েছে দূরবর্তী নভোমণ্ডল। যখন দ্বিতীয় বুদ্ধি তার স্রষ্টাকে লব্ধি করে, তখন উদ্ভব ঘটে তৃতীয় বুদ্ধির। এ প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে চলতে থাকে এবং যথাক্রমে সৃষ্টি করে চতুর্থ, ‘এঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম বুদ্ধিকে। আবার একই সাথে তা যথাক্রমে সৃষ্টি করে শনি, বৃহস্পতি, সূর্য, শুক্র, বুধ ও চন্দ্রের গোলক। অতিজাগতিক বুদ্ধি সৃষ্টি প্রক্রিয়া দশম বুদ্ধি সৃষ্টির সাথে সমাপ্ত হয়, আর নভোমণ্ডলের গোলকসৃষ্টি সমাপ্ত হয় সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। নভোমণ্ডলের নিম্ন প্রদেশে অবস্থিত পার্থিব প্রদেশ।
আল-ফারাবি দশ বুদ্ধির মতবাদের মাধ্যমে গতি ও পরিবর্তনের সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেছেন। এ একটি মতবাদের সাহায্যে তিনি একত্ব ও বহুত্ত্বের মধ্যকার সম্পর্ক; এরিস্টটলের চিরায়ত জড়তত্ত্ব ও ইসলামের সৃষ্টিতত্ত্বের সমন্বয় সাধনের প্রয়াস পেয়েছেন। দশ বুদ্ধির মতোই জড়পদার্থ পুরাতন। তবে জড়পদার্থ সৃষ্ট। কারণ তা চালক বৃদ্ধি থেকে বিকীর্ণ। চালক বুদ্ধি পরিপূর্ণভাবে আধ্যাত্মিক হলেও জড় জগতের সাথে তার একটি সম্পর্ক রয়েছে। আল-ফারাবি খোদার একত্ব প্রমাণ করার জন্য আল্লাহ এবং দশ বুদ্ধিতত্ত্বের অবতারণা করেছেন।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, মধ্যযুগের প্রেক্ষিতে আল-ফারাবির এ বিশ্বতাত্ত্বিক মতবাদকে সাফল্যজনক বলা যেতে পারে। কারণ বিশ্বতত্ত্ব সম্পর্কে কুরআনে অনেক আয়াত রয়েছে। সুতরাং এরিস্টটলের মতামত ও আল-ফারাবির এ ব্যাখ্যা কতকখানি কুরআনসম্মত তা তুলনামূলক আলোচনা করলে বুঝা যাবে। যতদূর জানা যায়, কোন অবস্থায়ই তিনি ইসলামি আদর্শ থেকে বিচ্যুত হন নি। তিনি একজন কাল অতিক্রান্ত মহান চিন্তানায়ক। সুতরাং মুসলিম দর্শনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।