আল-ফারাবির যুক্তিবিদ্যার বিষয়বস্তু সংক্ষেপে লিখ।

অথবা, আল-ফারাবির যুক্তিবিদ্যা সংক্ষেপে লিখ।

অথবা, যুক্তিবিদ্যা সম্পর্কে আল-ফারাবির মতামত কি?

অথবা, আল-ফারাবির যুক্তিবিদ্যা সম্পর্কে যা জান সংক্ষেপে লেখ।

অথবা, আল-ফারাবির যুক্তিবিদ্যার বিষয়বস্তু কী?

উত্তর: ভূমিকা: দর্শন চর্চার প্রাক প্রস্তুতি হিসেবে গণিতের ন্যায় যুক্তিবিদ্যা বিষয়ক জ্ঞান একান্ত অপরিহার্য। প্রাচীন ও মধ্যযুগে ভারত ও চীনে যুক্তিবিদ্যার চর্চা ছিল। সুতরাং যুক্তিবিদ্যার চর্চার ইতিহাস সুপ্রাচীন ও ব্যাপক। আল-ফারাবির যুক্তিবিদ্যা ব্যাকরণের উপর মন্তব্য ও টীকা এবং জ্ঞানতত্ত্বের আলোচনাকে অন্তর্ভুক্ত করে। যুক্তিবিদ্যা চিন্তার উপাদান নিয়ে যাত্রা শুরু করে এবং ক্রমান্বয়ে অতি জটিল ধারণায় প্রবেশ করে। অর্থাৎ শব্দ থেকে বাক্যে এবং বাক্য থেকে যুক্তিতে প্রবেশ করে থাকে।

যুক্তিবিদ্যার বিষয়বস্তু: আল-ফারাবির দৃষ্টিকোণ থেকে ধারণা, অবধারণ, জ্ঞানসূত্র, বিধেয়ক এবং ন্যায় অনুমান হলো যুক্তিবিদ্যার বিষয়বস্তু। নিম্নে এগুলো আলোচনা করা হলো:

ধারণা: আল-ফারাবি মনে করেন, চিন্তা হচ্ছে এমন মানসিক প্রক্রিয়া, যা কোন বস্তুর মৌলিক গুণাবলির ধারণা নির্দেশ করে। চিন্তা হলো কোন বস্তুর মৌলিক গুণাবলির মানসিক প্রতিচ্ছবি। চিন্তা হচ্ছে মানসিক কার্যাবলির প্রাথমিক সোপান। আল-ফারাবির মতে, ‘চিন্তা স্বজ্ঞা দ্বারা নির্ণীত’। আল-ফারাবির ধারণা স্বজ্ঞা দ্বারা নির্ণয় করা যায় এবং বস্তুটি আসলে কি ধরনের তাও বুঝা যায়।

অবধারণ: অবধারণের সৃষ্টি হয় ধারণার সমন্বয়ে। অবধারণ সত্য ও মিথ্যা উভয়ই হতে পারে। কতকগুলো স্বতঃসিদ্ধ আশ্রয়বাক্যের উপর অবধারণ নির্ভর করে। ধারণা থেকে আমরা অবধারণ এবং অবধারণ থেকে অনুমানের পথে অগ্রসর হই। আল-ফারাবি অবধারণ ও যুক্তিবাক্যের গঠনরীতি পঠনরীতি ও শ্রেণীবিন্যাস সম্পর্কে ‘ইসাগুজি’ শীর্ষক গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।

মৌলিক জ্ঞানসূত্র: গ্রিক ‘Categoria’ থেকে ইংরেজি ‘Category’ শব্দটি উদ্ভূত। গ্রিক শব্দটির অর্থ হলো যা কোন উদ্দেশ্যের বিষয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন ধরনের বিধেয় বিভিন্ন অবধারণের উদ্দেশ্যকে বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। জ্ঞানের এ অপরিহার্য মৌলিক ধারণাগুলো অভিজ্ঞতার পূর্বগামী সমস্ত মৌলিক ধারণাকে শোপেন হাওয়ার কার্যকারণ তত্ত্বে সীমিত করেছেন। মৌলিক জ্ঞানসূত্রের উপর আল-ফারাবি একখানা গ্রন্থ রচনা করেছেন। এরিস্টটলের জানসূত্রের পরিমাণের চেয়ে আল-ফারাবির দেওয়া জ্ঞানসূত্রের পরিধি ব্যাপক, অনেকটা কান্টের জ্ঞানসূত্রের কাছাকাছি।

বিধেয়ক: উদ্দেশ্য, বিধেয় এবং সংযোজক প্রতিটি যুক্তিবাক্যে থাকে। বিধেয়ক বলা হয় যুক্তিবিদ্যার উদ্দেশ্য পদের সাথে বিধেয় পদের সম্ভাব্য সকল প্রকার সম্বন্ধকে। যুক্তিবিদ্যার ভূমিকায় আল-ফারাবি (ক) জাতি, (খ) উপজাতি (গ) লক্ষণ, (ঘ) উপলক্ষণ, (ঙ) অবান্তর লক্ষণ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। কোন পদের সম্পূর্ণ জাত্যর্থ সুস্পষ্ট বর্ণনার নাম যৌক্তিক সংজ্ঞা। জাতি ও বিভেদক লক্ষণ নিয়ে যৌক্তিক সংজ্ঞা গঠিত। যেমন- ‘মানুষ হয় বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন জীব। অপরপক্ষে, পদের জাত্যর্থ ছাড়াও উপলক্ষণ এবং অবান্তর লক্ষণও থাকতে পারে সাধারণ বর্ণনাতে।

ন্যায় অনুমান: যে সমাধ্যম অবরোহ অনুমানে সম্মিলিতভাবে দু’টি আশ্রয়বাক্য থেকে একটি সিদ্ধান্ত অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হয় তাকে ন্যায় অনুমান বলে। ন্যায় অনুমানের উপর আল-ফারাবি ‘আল-কিয়াস’, ‘আল-সগির’ শীর্ষক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি উক্ত গ্রন্থে যুক্তিবাক্য, নিরপেক্ষ ন্যায় অনুমান, প্রাকল্পিক ন্যায় অনুমান, মিশ্র অনুমান, অমিশ্র ন্যায় অনুমান, ন্যায় অনুমানের পদ্ধতি প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, আল-ফারাবির যুক্তিবিদ্যা মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর যুক্তিবিদ্যার একটি প্রায়োগিক দিকও আছে। তিনি যুক্তিবিদ্যাকে নিছক তাত্ত্বিক কাঠামোর বেড়াজালে আবদ্ধ রাখেন নি। আল-ফারাবি মনে করেন, যুক্তিবিদ্যা শুধু চিন্তার সামঞ্জস্যতার বিজ্ঞান নয়, কিংবা কেবলমাত্র পদ্ধতি বিজ্ঞানও ন্যয়, এটা এর চেয়েও বেশিকিছু। জ্ঞাত ও সুপ্রতিষ্ঠিত ধারণা দিয়ে শুরু করা যুক্তিবিদ্যার কাজ এবং তাদের থেকে এমন কিছু নিঃসৃত করা, যা পূর্বে অজ্ঞাত ছিল।