অথবা, ইবনে রুশন যুক্তিবিদ্যা বলতে কী বুঝেন?
অথবা, ইবনে রুশদের যুক্তিবিদ্যা সম্পর্কে ধারণা দাও।
অথবা, সংক্ষেপে ইবনে রুশদের যুক্তিবিদ্যা ব্যাখ্যা কর।
অথবা, ইবনে রুশদের যুক্তিবিদ্যা সংক্ষেপে তুলে ধর।
উত্তর: ভূমিকা: যুক্তিবিদ্যা দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। যুক্তিবিদ্যা হলো চিন্তার বিজ্ঞান। যুক্তিবিদ্যার উপর ইবনে রুশদ যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তিনি এরিস্টটলের বিভিন্ন অবদানের মধ্যে যুক্তিবিদ্যাকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন। এরিস্টটলের যুক্তিবিদ্যাকে অনুসরণ করে তিনি নিজস্ব একটি যুক্তিবিদ্যা গড়ে তোলার প্রয়াস পান। যতদূর জানা যায়, সক্রেটিস এবং প্লেটো অনেক বড়মাপের দার্শনিক হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা যুক্তিবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন না। তবে ইবনে রুশদ যুক্তিবিদ্যায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।
ইবনে রুশদের যুক্তিবিদ্যা: ইবনে রুশদ যুক্তিবিদ্যা বলতে এমন বিদ্যাকে বুঝেন যে বিদ্যা মানলো চিন্তাকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য স্তর থেকে বিশুদ্ধ বুদ্ধির স্তরে উন্নীত করে। যুক্তিবিদ্যার কাজ চিন্তাকে গঠনমূলকভাবে পরিচালিত করে দৃশ্যমান জগতের অন্তরালের বিমূর্ত সত্যকে উপলব্ধি করা এবং তাঁর অনুশীলন করা।
সবার পক্ষে যুক্তিবিদ্যার অনুশীলন সম্ভব নয়। যুক্তিবিদ্যার অনুশীলন শুধু উচ্চতর ধীশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিকাই করতে পারে। ইবনে রুশদের মতে, সাধারণ মানুষ মূলত ইন্দ্রিয়বাদী, তাদের জ্ঞানের স্তর ইন্দ্রিয়ের চৌহদ্দিতে সীমাবদ্ধ। তাঁরা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যা অবগত হন তার অন্তরালে অন্যকিছু তারা ভাবতে পারে না। কিন্তু চিন্তাভাবনাকে ইন্দ্রিয় জগতের উর্ধ্বে উঠাতে সক্ষম এমন লোকের সংখ্যা খুব কম। মানুষকে অজ্ঞাত থাকার জন্য আল্লাহ জগত সৃষ্টি করেন নি। জগতকে তিনি মানুষের কাছে তুলে ধরতে চান। তিনি জগত সম্পর্কে ভারতে মানুষকে নির্দেশ দেন। জগতের মূল রহস্য নিয়ে সবাই চিন্তাভাবনা করে না।
সংস্কারমুক্ত জ্ঞান যুক্তিবিদ্যার মাধ্যমে লাভ করা যায়। যুক্তিই কেবল পক্ষপাত করে না। যুক্তির কাছে সত্যই আরাধ্য অন্য কিছু নয়। যুক্তিবিদ্যায় যাঁরা সাধনা করে গেছেন তারা প্রকারান্তে সত্যের সাধনা করেছেন। ইবনে রুশদ মনে করেন, এরিস্টটল যুক্তিবিদ্যার সাধনা করেছেন, ফলে তিনি সত্য জ্ঞান প্রাপ্ত। তিনি জগত জীবনের পরম সত্য তথা পরমসত্তার জ্ঞানে পৌঁছেছিলেন। জাগতিক বিভিন্ন রহস্যের জাল ভেদ করে তিনি সত্যের আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বময়। রুশদও সত্যের প্রয়াসী। তাঁর দাবি, তিনি সত্যকে জানার জন্যই জন্মগ্রহণ করেছেন। ইবনে রুশদ মনে করেন, যুক্তিবিদ্যার শিক্ষা শুধু তত্ত্ব জ্ঞানের জন্যই নয়, বরং উন্নত ও সুখী জীবনের জন্যও আবশ্যক। তাঁর ধারণা যথার্থ সত্য জ্ঞান লাভ করতে পারলে মন থেকে বিভিন্ন কুসংস্কারের অন্ধকার দূরীভূত হয়, মন হয়ে উঠে নিষ্কলুষ। আর নির্ভেজাল সুখ লাভ করা এ নিষ্কলুষ মনের মানুষের পক্ষেই সম্ভব।
ইবনে রুশদ মনে করেন, যুক্তিবিদ্যার সাথে ভাষার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ফলে যুক্তির যথার্থ প্রকাশের জন্য ভাষাগত বিশুদ্ধতার দিকে লক্ষ্য করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ব্যাকরণের প্রতি তিনি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। যুক্তিবিদ্যা চিন্তার সাধারণ সূত্র আবিষ্কার করে। ভাষার মাধ্যমে চিন্তা প্রকাশিত হয়। আর ভাষার সাধারণ সূত্র প্রদান করে ব্যাকরণ। ফলে যুক্তিবিদ্যা ও ব্যকারণ একে অন্যের পরিপূরক। ইবনে রুশদের মতে, এরিস্টটল এ বিষয়টি সম্পর্কে বিশেষভাবে সচেতন ছিলেন। তাঁর ধারণা, এরিস্টটলের Hermenautics এবং Phetoric ইত্যাদি রচনায় ভাষার সাধারণ সূত্র অনুসরণ করা হয়েছে। ব্যাকরণের গুরুত্ব স্বীকারের একটি স্পষ্ট উদাহরণ।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ইবনে রুশদের যুক্তিবিদ্যা মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তিনি যুক্তিবিদ্যা অধ্যয়নের ক্ষেত্রে ভাষার উপর যেভাবে দৃষ্টি দিয়েছেন এবং ব্যাকরণের সাথে যুক্তিবিদ্যার যে নির্ভরশীলতার বিষয়টি তুলে ধরেছেন তা তাঁর মতবাদের একটি মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ দিক। তাছাড়া তিনি যুক্তিবিদ্যাকে সুখশান্তি লাভের মাধ্যম হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাছাড়া যুক্তিবিদ্যা অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষের মনের কিছু কুসংস্কার নিরসন করা সম্ভব। সুতরাং তাঁর আলোচিত যুক্তিবিদ্যার ভূমিলা সম্পর্কে সন্দেহ করার কোন অবকাশ নেই।