ইবনে রুশদ কিভাবে আত্মার অবিনশ্বরতা বা অমরত্বের পক্ষে দার্শনিকদের যুক্তিসমূহ ও গাজালির যুক্তিসমূহকে মূল্যায়ন করেছেন?

অথবা, আত্মার অবিনশ্বরতা বা অমরত্বের পক্ষে ইবনে রুশদের মতবাদ ব্যাখ্যা কর।

অথবা, আত্মার অবিনশ্বরতা বা অমরত্বের পক্ষে ইবনে রুশদের মতবাদ আলোচনা কর।

অথবা, আত্মার অবিনশ্বরতা বা অমরত্বের পক্ষে ইবনে রুশদ যে মতবাদ দেন বিস্তারিত বিশ্লেষণ কর।

অথবা, আত্মার অবিনশ্বরতার পক্ষে ইবনে রুশদ কিরূপ মতবাদ দেন বর্ণনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: ইবনে রুশদ মুসলিম জাহানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক হিসেবে পরিচিত। তিনি কর্ডোভাতে ১১২৬ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। ইউরোপীয় চিন্তাধারা রেনেসাঁর সময় পর্যন্ত তার দার্শনিক সিদ্ধান্ত ও সূত্রগুলো দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিল বলে তাকে অনেকে ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক প্রভাবশালী দার্শনিক বলে গণ্য করেন। ইবনে রুশদ যেসব দার্শনিক মতবাদ দিয়েছেন তার মধ্যে আত্মার অমরত্ব অন্যতম। আত্মার অবিনশ্বরতা প্রসঙ্গে সকল মুসলিম দার্শনিকই একমত। আত্মার অমরত্ব সম্পর্কে ইবনে রুশদ মূলত গাজালির মতবাদ সমালোচনা করেন।

আত্মার অমরত্ব সম্পর্কে ইবনে রুশদের মতবাদ: ইবনে রুশদ “Tahafut al Tahafut” নামক গ্রন্থে আত্মার অমরত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। দার্শনিক যুক্তির মাধ্যমে যখন আত্মার অবিনশ্বরতা প্রমাণ করতে গিয়েছেন তখন তাদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়। ফালাসিফা সম্প্রদায়ের মুসলিম দার্শনিকগণ আত্মার অমরত্ব সম্পর্কে যেসব যুক্তি দিয়েছেন গাজালি সেগুলোকে ত্রুটিপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন। আর ইবনে রুশদ গাজালির এ যুক্তিসমূহকে খণ্ডন করার প্রয়াস নেন। নিম্নে ইবনে রুশদের মতবাদ তুলে ধরা হলো:

১. আত্মা দেহান্তর: মুসলিম দার্শনিকগণ আত্মাকে দেহান্তর বলেছেন। তাদের মতে, আত্মা দেহের বহিরাগত কিছু। ইমাম গাজালি এ মতের বিরোধিতা করেন। তাঁর মতে, আত্মা যদি বহিরাগত একটা কিছু হয়, তাহলে দেহ ধ্বংসের সাথে আত্মত্মাকেও ধ্বংসের বিষয়টি অনুমোদন করা যায় না। ইবনে রুশদ বলেন যে, আল গাজালির এ অভিযোগ যথার্থ নয়। কারণ যেভাবে তিনি গোটা দার্শনিকদের একদলভুক্ত করেছেন তা সংগত নয়। কারণ ইবনে সিনার মতবাদ সকল সার্শনিকদের মতবাদ নয়।

২. একটি ধ্বংস অন্যটিকে ধ্বংস করে না: ইবনে রুশদের মতে, গাজালির এ মতের বিরুদ্ধে দার্শনিকগণ যুক্তি দিতে পারেন যে, দুটি বস্তু বা বিষয়ের মধ্যে সংযুক্ততার সম্পর্ক বা ভালোবাসার সম্পর্ক থাকলেও এটা আবশ্যিক নয় যে, একটি ধ্বংসের সাথে অন্যটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। যেমন- প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্ক চুম্বক ও লোহার মধ্যকার সম্পর্কের কথা তুলে ধরেন। যেখানে একটির ধ্বংস অনিবার্যভাবে অন্যটিকে ধ্বংস করে না।

৩. আবশ্যিকতা: ইবনে রুশদই একমাত্র দার্শনিক যিনি ধ্বংস সম্পর্কীয় আবশ্যিকতার কথা বলেছেন। কারণ সংখ্যাগত ভিন্নতায় তিনি আত্মাকে বিশিষ্ট করেছেন। সকল দার্শনিকই এটা স্বীকার করেন যে, এক ধরনের স্বর্গীয় রশ্মি আছে, যা সকল সম্ভাব্য সত্তার মূল ভাগে বর্তমান রয়েছে। প্রাণী ও উদ্ভিদ সবকিছু এ স্বর্গীয় রশ্মি বা শক্তিই উৎপন্ন করে।

৪. ঐশী প্রাকৃতিক সম্ভাব্যতা: সম্ভাব্য সত্তাকে কিছু কিছু দার্শনিক ঐশী প্রাকৃতিক সম্ভাব্যতা বলে থাকেন। কিন্তু গ্যালেন প্রমুখ দার্শনিক একে আকারিক শক্তি অথবা ডেমিয়াজ বলে আখ্যায়িত করেন। তার মতে, জাগতিক বিষয়টি এমন যে, জগত সৃষ্টির একজন জ্ঞানী নির্মাতা আছেন, যিনি এসব সৃষ্টি করেছেন এবং এটি এমন একটি সৃষ্টি প্রক্রিয়া, যা শরীর বিদ্যার আওতার বাইরে। তবে সে নির্মাতায় স্থান এবং সারসত্তা এত সুউচ্চ যে, তাকে বুঝা মানবিক বুদ্ধির পক্ষে অত্যন্ত কষ্টকর। ইবনে রুশদ বলেন, প্লেটো এর মাধ্যমেই প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, আত্মা দেহ থেকে পৃথক সত্তা। তার মতে, যদি আত্মার অস্তিত্বের জন্য দেহ শর্ত হয়, তাহলে আত্মা দেহকে সৃষ্টি করতে বা গঠন করতে পারবে না।

৫. আধ্যাত্মিক উপাদান বিশ্ব আত্মা: ইবনে রুশদের মতে, দার্শনিকগণ এখনো অস্বীকার করেন না যে, এমন এক প্রকার উপাদানসূচক আত্মা আছে যা প্রাণী, উদ্ভিদ এবং সর্বপ্রকার প্রাকৃতিক বস্তু সৃষ্টি করে। আত্মা স্বর্গীয় দেহ এবং সংবেদনশীল দেহের মধ্যবর্তী একটা কিছু। দেহ ধ্বংসের পর আত্মা তাদের আধ্যাত্মিক উপাদানে ফিরে আসে। এ আধ্যাত্মিক উপাদান হচ্ছে বিশ্বাত্মা। ইবনে রুশদ বলেন, এ অবস্থায় আত্মা নিজের স্বকীয়তা হারায়।

৬. জৈব উচ্চতা: দার্শনিকদের মতবাদের বিরুদ্ধে গাজালি বলেন, দেহের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকলেই আত্মার ব্যক্তিত্ব বা স্বাতন্ত্র্য বিদ্যমান থাকে। দেহ ধ্বংসের পর তার আর কোন স্বাতন্ত্র্য থাকে না। ইবনে রুশদ বলেন, এটি মূলত ইবনে সিনার মতবাদ। কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি ইবনে সিনাকে সমর্থন করেন। রুশদ গাজালির মতের বিপক্ষে বলেন যে, দেহের মৃত্যুর পর আত্মা অতি সূক্ষ্ম অপ্রত্যক্ষণযোগ্য অংশ ধারণ করে টিকে থাকে। এ অপ্রত্যক্ষণীয় অংশকে ইবনে রুশদ এক ধরনের জৈব উষ্ণতা বলে অভিহিত করেন।

৭. আত্মার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব অস্বীকার : ইবনে রুশদ আত্মার স্বতন্ত্র অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না। তার মতে, প্রাচীন দার্শনিকদের মধ্যে কেউ সাধারণত আত্মার অমরত্বে অবিশ্বাস করেন নি। তারা শুধু আত্মাকে দেহের সাথে করে ভাবতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। রুশদের ধারণা আত্মা ব্যক্তির দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর বিশ্ব আত্মার সাথেই মিশে যায়। ফলে মৃত্যুহীন আত্যা একটি বিশেষ আত্মা বা ব্যক্তি নয় এটি সর্বজনীন আত্মার সাথে একাকার।

৮. মানবাত্মার মধ্যে বিশ্বাত্মার প্রতিফলন: ইবনে রুশদের মতে, মানবাত্মার মধ্যে বিশ্বাত্মার প্রতিফলন ঘটে। তার বিশ্বাত্মা হলো এমন একটা কিছু, যাকে এরিস্টটল জড়হীন আকার বলেছেন। ব্যক্তির দেহের মাঝে এ বিশ্ব আত্মার অংশ থাকে। ইবনে রুশদ মনে করেন, এরিস্টটল এভাবে আকারের আকার স্বীকার করার জন্য তার পূর্বসূরী এ্যানাক্সেগোরাসকে প্রশংসা করেছেন।

মূল্যায়ন: মুসলিম দার্শনিকগণের প্রায় সকলেই আত্মার অবিনশ্বরতায় বিশ্বাস করেন। আর ইবনে রুশদের মতবাদ অনেকটা ফালাসিফা মুসলিম দার্শনিকদের মতোই। যেসব বিষয়ে তিনি স্বকীয় কিছু দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করেছেন এবং ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন তার ভিত তেমন শক্ত নয়। মূলত তিনি আত্মার অমরত্বের পক্ষে যেসব যুক্তি দিয়েছেন তা অত্যন্ত দুর্বল প্রকৃতির। আত্মার ব্যক্তিগত অমরত্বে ইবনে রুশদ বিশ্বাস করেন না। যদি আত্মা বিশ্ব আত্মার সাথে মিশে যায়, তবে শান্তি বিধান করলে সকল আত্মার উপর তা সংঘটিত হবে। উল্লেখ্য যে, ইবনে রুশদের এ আত্মাতত্ত্ব আল্লাহর ন্যায়বিচারের বিষয়টিকে নিশ্চিত করতে পারে না। তবে ইসলামের বিধান অনুযায়ী পরকালীন জীবনের ন্যায়বিচার একটি চিরন্তন সত্য কথা। আর এর উপর সকল মুসলমানদের ঈমান আনয়ন করা কর্তব্য।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে বলা যায় যে, একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে ইবনে রুশদ আত্মাকে আধ্যাত্মিক বলেছেন। তিনি মূলত ফালাসিফা দার্শনিকদের বিরুদ্ধে ইমাম আল গাজালি যেভাবে প্রতিবাদ করেছেন তার বিরুদ্ধে দার্শনিকদের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। কারণ গাজালি সকল মুসলিম দার্শনিকদের উপর একই অভিযোগ করেছেন। সুতরাং মুসলিম দর্শনে ইবনে রুশদের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ।