অথবা, আত্মা সম্পর্কিত ইবনে সিনার মতের ব্যাখ্যা দাও।
অথবা, ইবনে সিনার আত্মাতত্ত্ব আলোচনা কর।
অথবা, ইবনে সিনার আত্মাতত্ত্ব বিস্তারিত বিশ্লেষণ কর।
অথবা, আত্মা সম্পর্কে ইবনে সিনা কিরূপ মতবাদ দেন বিস্তারিত লেখ।
উত্তরঃ ভূমিকা: মুসলিম জাহানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ ইবনে সিনা তাঁর মনের গভীরতা, চিন্তাশক্তির প্রখরতা ও বিশ্বজনীন উদার দৃষ্টিভঙ্গির জন্য বিশ্বের সুধী সমাজে বিশেষভাবে সুপরিচিত। ইবনে সিনার পুরো নাম আবু আলী আল হুসায়ন ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সিনা। ল্যাটিন ভাষায় তিনি আবি সিনা (Svicenna) এবং হিব্রুতে আবেন সিনা (Svensina) নামে পরিচিত। তিনি একাধারে দার্শনিক, চিকিৎসক, গাণিতিক ও জ্যোতির্বিদ ছিলেন। তিনি এরিস্টটলের দর্শনের একজন সফল ভাষ্যকার। তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় মুসলিম বিশ্বে এরিস্টটলের দর্শন চর্চা বিশেষভাবে প্রসারিত হয়। মুসলিম দর্শনে আল-ফারাবি যে নব্য প্লেটোবাদী ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সে ঐতিহ্যের প্রাচ্যদেশীয় শ্রেষ্ঠতম প্রবক্তা ও ব্যাখ্যাকারী ছিলেন ইবনে সিনা। সমসাময়িক এমনকি পরবর্তীকালে পাঠক ও বিদগ্ধ সমাজে তাঁর মতাবলি সমর্থিত হয়েছিল বর্ণনার স্বতঃস্ফূর্ত এবং রচনার গুণগতমানের উৎকৃষ্টতার জন্য।
ইবনে সিনার আত্মা তত্ত্ব: ইবনে সিনার গুরুত্বের সাথে আত্মা সম্পর্কিত আলোচনা করেছেন। তাই আত্মা সম্পর্কিত আলোচনায় আমরা প্রথমে যে, জিনিসটি দেখতে পাই, সেটি হলো ইবনে সিনা দেহ ও মনের দ্বৈততা স্বীকার করেছেন। নিম্নে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচিত হলো:
আস্থার প্রকৃতি: দেহের সাথে আত্মার কোন আবশ্যিক বা অনিবার্য সম্পর্ক নেই। আদি প্রভাবে সমস্ত দেহ গঠিত। তবে মানবদেহে এ উপাদানের সংযোগ অত্যন্ত বিশোধিত। অন্যান্য দেহের চেয়ে এ উপাদান মানবদেহে অধিক পরিমাণে সমন্বিত ও সংগঠিত। আকস্মিকভাবে আত্মা মানবদেহের সাথে সংযুক্ত হয়েছে। আর তাই এটি দেহের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়। প্রতিটি দেহ বিশ্বআত্মা হতে আত্মা প্রাপ্ত হয় এবং সে আত্মা দেহের সাথে খাপখাইয়ে নেয়। আত্মা একটি ব্যক্তিক দ্রব্য বা Individual Substance দৈহিক শৃঙ্খলে অবস্থানকালে আত্মার ব্যক্তিত্বের বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অভিব্যক্তি ঘটে। আত্মার রয়েছে বিভিন্ন অবস্থা বা ক্রমস্তর।
আত্মার প্রকার: আত্মার আলোচনাকে আরও সুসংঘবদ্ধ করতে তিনি আত্মার বিভিন্ন প্রকারের কথা বলেছেন। তার
মতে, আত্মা তিন প্রকার। যথা:
ক. উদ্ভিদ আত্মা বা Vegetable soul, খ. জীবাত্মা বা Animal soul, গ. মানবাত্মা বা Human soul.
ক. উদ্ভিদ আত্মা বা Vegetable soul.: ইবনে সিনা প্রথম আত্মার কথা বলেছেন, সেটি হলো উদ্ভিদ আত্মা। তার মতে, উদ্ভিদ আত্মার তিনটি বৃত্তি রয়েছে। সেগুলো হলো:
১. পুষ্টি সাধন: এটি যখন দেহে অবস্থান করে তখন অন্য দেহকে পূর্ব আকারে পরিবর্তন করতে পারে।
২. বর্ষন: উদ্ভিদ আত্মার রয়েছে বর্ধন শক্তি। পূর্ণতা প্রাপ্তি না হওয়া পর্যন্ত শক্তি দ্বারা নিজের আকার ঠিক রেখে অব্যাহতভাবে নিজেকে বৃদ্ধি সাধন করতে থাকে।
৩. পুনরুৎপাদন: উদ্ভিদের আরেকটি বৃত্তি হলো পুনরুৎপাদন শক্তি। এ শক্তি নিয়ে বাস্তবে তার সাদৃশ্যে অন্য দেহ উৎপাদনে সক্ষম।
খ. জীবাত্মা বা Animal soul. : ইবনে সিনা দু’প্রকার আত্মার নাম দিয়েছেন জীবাত্মা। উদ্ভিদ আত্মার মত এরও কিছু বৃত্তি রয়েছে। তবে সেটি দু’ধরনের। যথা:
১. সঞ্চালন বৃত্তি: সঞ্চালন বৃত্তি দুই শক্তিরূপে প্রকাশিত হয়, সেগুলো হলো ক. ক্ষুন্নিবৃত্তি এবং খ. ক্রিয়াশক্তি। ক্ষুন্নবৃত্তি স্বয়ং আকর্ষণীয় অথবা প্রতিক্রিয়ামূলক হতে পারে। আকর্ষণীয় হলে তার প্রকাশ ঘটে শুধু কামনা দ্বারা। প্রতিক্রিয়ামূলক হলে তার অভিব্যক্তি বা প্রকাশ ঘটে রুক্ষ মেজাজের দ্বারা।
২. প্রত্যক্ষমূলক বৃত্তি: জীবাত্মার প্রত্যক্ষমূলক বা জ্ঞানমূলক বৃত্তিসমূহ দু’প্রকার। ক. বাহ্য ও খ. আন্তর। বাহ্য বৃত্তির মধ্যে আছে দেখা, শোনা, ঘ্রাণ, স্বাদ এবং স্পর্শ। আন্তর শুরু হয় সাধারণ জ্ঞান দ্বারা।
গ. মানবাত্মা বা Human soul. : মানবাত্মার ব্যাখ্যায় ইবনে সিনা যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দেন। তাঁর মতে, একমাত্র মানবাত্মারই রয়েছে প্রজ্ঞা বা বুদ্ধি, প্রজ্ঞ বা বুদ্ধি দুই প্রকার, যথা। ব্যবহারিক প্রজ্ঞা ও ii. তাত্ত্বিক প্রজ্ঞা। ব্যবহারিক বুদ্ধির উপর নৈতিকতা নির্ভরশীল। আর তাত্ত্বিক বুদ্ধি আমাদেরকে অমূর্ত চিন্তা করতে সক্ষম করে তোলে। অর্থাৎ, ব্যবহারিক বুদ্ধি আমাদেরকে ভালোমন্দ সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে। শুধু তাই নয়, কোনটি নৈতিক আদর্শ তাও আমাদেরকে নির্দেশ দেয়।
মন্তব্য: নিম্নতর প্রাণীর ন্যায় মানুষও ইন্দ্রিয় দ্বারা বিশেষভাবে বস্তুকে প্রত্যক্ষণ করে। বাহ্য ইন্দ্রিয়ের সাহায্য ব্যতিরেকে প্রাজিক আত্মা তার ক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন হয়। এর অর্থ হচ্ছে আত্মা যদিও দেহের সংযুক্ত, তবুও এটা দেহ হতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও স্বাধীন। তবে ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার জন্য আত্মা দেহের’ উপর নির্ভরশীল, যাকে সে সংশ্লেষণ এবং সমন্বয় করে। ইবনে সিনার মতে, প্রাজিক আত্মা এভাবে অন্যান্য শক্তির উপর প্রাধান্য বিস্তার করে। আত্মার নিকট দেহ এবং সমগ্র বস্তু জগৎ উপস্থিত হয়। আত্মার প্রশিক্ষণের জন্য এটি ক্ষেত্রস্বরূপ। প্রতিটি জীবের রয়েছে একটি আত্মা। কিন্তু দেহের পূর্বে এটি অস্তিত্বশীল ছিল না। দেহের উদ্ভব প্রক্রিয়ার সাথে যুগপৎভাবে চালিকা বুদ্ধি থেকে এর উদ্ভব ঘটে।
উপসংহার: উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, ইবনে সিনা আরব সভ্যতায় প্রাচীন গ্রিসের জ্ঞানবিজ্ঞান এবং দর্শনকে সংযোজন করেন এবং আরব সভ্যতার মাধ্যমে ইউরোপে সে অমর জ্ঞান সম্ভারকে পৌছে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অতুলনীয়। তার দর্শনে আমরা ভাববাদ ও বস্তুবাদ উভয় ধারণাই পাই। তিনি গতি, শূন্যতা, তাপ, আলো, স্থানিক আকর্ষণ প্রভৃতি ক্ষেত্র গবেষণা করেন। সে যুগে প্রচলিত আলকেমি বিদ্যার ধাতু রূপান্তরবাদকে তিনি স্বীকার করেন। ইবনে সিনা শুধু তাঁর যুগের চিন্তাধারার অগ্রদূত ছিলেন না, বরং তাঁর দার্শনিক মতবাদ অনেক ক্ষেত্রে আধুনিক দর্শনসহ পরবর্তী দার্শনিক ঐতিহ্যের পূর্বাভাস। মূলত মুসলিম প্রাচ্যে আল-গাজালি পূর্ববর্তী চিন্তাবিদ তার মত এত অধিক জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হতে পারেন নি।