ইবনে সিনার আত্মাতত্ত্ব সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।

অথবা, ইবনে সিনার আত্মাতত্ত্ব কী?

অথবা, আত্মা সম্পর্কে ইবনে সিনার বক্তব্য কী?

অথবা, ইবনে সিনার আত্মাতত্ত্ব বলতে কী বুঝ?

অথবা, সংক্ষেপে ইবনে সিনার আত্মাতত্ত্ব লেখ।

অথবা, ইবনে সিনার আত্মাতত্ত্ব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা দাও।

অথবা, ইবনে সিনার আত্মাতত্ত্ব সম্পর্কে যা জান সংক্ষেপে লেখ।

উত্তর: ভূমিকা: মুসলিম দর্শনের অন্যতম খ্যাতনামা দার্শনিক হলেন ইবনে সিনা। তিনি দর্শনের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি একাধারে একজন দার্শনিক একজন চিকিৎসাবিদ এবং একজন বিজ্ঞানী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি দেহ ও আত্মার মাধ্যমে মানব জীবনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন যা তাঁর আত্মাতত্ত্ব নামে পরিচিত। তিনি মূলত দেহ ও আত্মার দ্বৈতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন।

ইবনে সিনার আত্মাতত্ত্ব: ইবনে সিনার মতে, দেহের সাথে আত্মার কোন অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক নেই। আত্মা আকস্মিকভাবে দেহ সংযুক্ত হয়েছে। প্রত্যেক দেহ বিশ্ব আত্মা থেকে আত্মা পেয়ে থাকে। দেহে অবস্থানকালে আত্মা ক্রমবর্ধমানভাবে নিজেই এক পৃথক সত্তা হিসেবে বিকশিত হয়। অর্থাৎ আত্মা বিভিন্ন অবস্থার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়। ইবনে সিনা আত্মার এক ধারাবাহিক অনুক্রম তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে আত্মা তিনটি অবস্থার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়। যথা:

ক. উদ্ভিদ আত্মা

খ. জীবাত্মা

গ. মানবাত্মা

ক. উদ্ভিদ আত্মা: আত্মার সরল ও প্রাথমিক আত্মা হচ্ছে উদ্ভিদ আত্মা। এ আত্মার তিনটি বৃত্তি বা শক্তি রয়েছে।
যথা: ১. বর্ধন শক্তি, ২. বিকাশের ক্ষমতা এবং ৩. পুনরুৎপাদনের শক্তি। এখানে বর্ধন শক্তি দেহে অবস্থানকালে অন্য দেহকে পূর্ব থেকে পরিবর্তন করতে পারে, বিকাশের ক্ষমতাবলে দেহ নিজ আকার ঠিক রেখে পরিপূর্ণ বিকাশ প্রাপ্ত হয়। পুনরুৎপাদনের শক্তি দেহ থেকে কিছু শক্তি নিয়ে পূর্ব দেহের অনুরূপ দেহ উৎপাদন করতে পারে।

খ. জীবাত্মা: উদ্ভিদ আত্মার পরবর্তীতে রয়েছে জীবাত্মা। জীবাত্মার দুটি শক্তি বা বৃত্তি রয়েছে যথা: ১. প্রেষণা বৃত্তি,
২. জ্ঞানমূলক বৃত্তি। প্রেষণা বৃত্তির মধ্যে রয়েছে কামনা, বাসনা ইত্যাদি আবেগমূলক শক্তিসমূহ। এ শক্তিসমূহ আকর্ষণীয় বা বিরক্তিকর হতে পারে। আকর্ষণীয় হলে এ শক্তি কামনা হিসেবে বিবেচিত হবে এবং বিরক্তিকর হলে এ শক্তি ক্ষুব্ধ মেজাজ বলে বিবেচিত হয়। আর কোন কিছুকে গ্রহণ বা ধারণ করার ক্ষমতা হচ্ছে জ্ঞানমূলক বৃত্তির অন্তর্গত। মানবাত্মার পর্যায়ে জ্ঞানমূলক বৃত্তি আবার দুই ভাগে বিভক্ত যথা: বাহ্যবৃত্তি ও অন্তরবৃত্তি। বাহ্যবৃত্তির মধ্যে রয়েছে দর্শন, শ্রবণ, ঘ্রাণ, স্বাদ ও স্পর্ণা এ পঞ্চ ইন্দ্রিয়। বাহ্য জগতের জ্ঞান এ পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত। আন্তর জ্ঞানের উৎপত্তি সাধারণ জ্ঞানে। উচ্চতর বৃত্তি দ্বারা বিকশিত না হওয়া পর্যন্ত সব রকম প্রত্যক্ষণ এ কেন্দ্রে অবস্থান করে।

গ. মানবাত্মা: ইবনে সিনা মনে করেন, একমাত্র মানবাত্মাই উচ্চতর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী। উচ্চতর মানবীয় বুদ্ধিকে ইবনে সিনা অনেকটা কান্টীয় রূপরেখায় প্রজ্ঞা বা বুদ্ধিকে বিবেচনা করেন। তাঁর মতে, প্রজ্ঞার দুটি রূপ যথা:

১. ব্যবহারিক প্রজ্ঞা বা বুদ্ধি,

২. তাত্ত্বিক প্রজ্ঞা।

ব্যবহারিক প্রজ্ঞার উপর নৈতিকতা নির্ভর করে এবং তাত্ত্বিক প্রজ্ঞা আমাদের অমূর্ত চিন্তা করতে সক্ষম করে তোলে। মানবাত্মার বাড়তি গুণাবলির মধ্যে রয়েছে অনুধ্যানী ও বিচারবিশ্লেষণী ক্ষমতা। এসব গুণাবিলকে পরিমাপমূলক বৃত্তি বলা হয়। যার কাজ এসব ধারণাকে অবধান এ পরিণত করা। এসব গুণের জন্যই মানবাত্মাকে প্রজিক আত্মা বলে চিহ্নিত করা হয়। মস্তিষ্কের পশ্চাদ ভাগে অবস্থিত স্মৃতি শক্তিই হচ্ছে জীবাত্মার শেষ শক্তি।

উপসংহার: উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, ইবনে সিনা তার আত্মা তত্ত্বে আত্মাকে মন ও দেহ থেকে পৃথক করে উভয়ের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর তত্ত্বে তিনি অনেকটা সফল হয়েছেন। তাঁর মতে, আত্মা দেহ সবই নিরপেক্ষ, আত্মা অমর ও অবিনশ্বর। তার এ বর্ণনা ধর্মতত্ত্বের সাথে অনেকটা সঙ্গতিপূর্ণ। এসব কারণে মুসলিম দর্শনে ইবনে সিনার আত্যা তত্ত্বটি গুরুত্বের দাবিদার।