ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি লাভের গুরুত্ব আলোচনা কর।

অথবা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি লাভসম্পর্কে বর্ণনা কর।

অথবা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি
লাভের ইতিহাস লিখ।

অথবা, কোম্পানি শাসন প্রতিষ্ঠায় দেওয়ানীর গুরুত্ব বর্ণনা কর।

উত্তর: ভূমিকা: বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইংরেজ প্রভূত্ব স্থাপনের ইতিহাসে দেওয়ানি লাভ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। দেওয়ানি লাভের মাধ্যমেই এদেশে কোম্পানির আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠার সূত্রপাত ঘটে এবং ঘটনা পরম্পরায় তাদের বাংলা ও ভারত বিজয়ের পথ সুপ্রশস্ত হয়। এমন কি কোম্পানি কর্তৃক দেওয়ানি লাভকে বাংলা তথা ভারতে ইংরেজ প্রভূত্ব স্থাপনের তৃতীয় ও শেষ অধ্যায় বলে অভিহিত করা যায়।

দেওয়ানি: ১৭৬৫ সালে রবার্ট ক্লাইভ দ্বিতীয়বার বাংলার এর গভর্নর হিসেবে এদেশে আসেন। ইতঃপূর্বে তিনি এদেশে ৬ ইংরেজদের কর্তৃত্ব স্থাপনের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন। দ্বিতীয়বার কার্যক্ষমতা গ্রহণ করে তিনি ইংরেজদের প্রত্যক্ষ কর্তৃত্ব বিস্তারের পথ উন্মুক্ত করেন। মীর কাসিম মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম ও অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলার সাথে মিত্রতা স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু সম্মিলিত বাহিনী বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত হয়। ক্লাইভ পরাজিত সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম ও অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলার সাথে এলাহাবাদের চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ সন্ধির শর্তানুযায়ী অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা অযোধ্যা ফিরে পান। তবে এর বিনিময়ে ইংরেজরা যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ স্বরূপ ৫০ লাখ টাকা লাভ করে। নবাব এলাহাবাদ ও কারা জেলা দু’টিও ইংরেজদেরকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। ক্লাইভ এলাহাবাদ ও কারা জেলা দু’টি এবং ২৫ লাখ টাকা কর প্রদানের শর্তে সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করেন।

ইস্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি লাভের গুরুত্ব : দেওয়ানি লাভের গুরুত্বকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এ দুই ভাগে বিভক্ত করে আলোচনা করা যায়। যথা:

(ক) দেওয়ানি লাভের রাজনৈতিক গুরুত্ব: কোম্পানি কর্তৃক দেওয়ানি লাভের রাজনৈতিক গুরুত্বের বিভিন্ন দিক নিম্নে দেওয়া হলো:

১. কোম্পানি রাজস্ব আদায়কারী হিসেবে মর্যাদা লাভ: পূর্বে কোম্পানি ছিল একটি বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান। অন্য কোনো বিষয়ে এর – সম্পৃক্ততা ছিল না কিন্তু দেওয়ানি লাভ করার পর কোম্পানি এখান হতে রাজস্ব আদায়কারীর মর্যাদা লাভ করেছিল।

২. দিল্লির সম্রাটের ক্ষমতা হ্রাস: কোম্পানি কর্তৃক দেওয়ানি লাভের ফলে দিল্লির সম্রাটের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি, সম্মান ও মর্যাদা বহুল পরিমাণে হ্রাস পায়। দিল্লির সম্রাট কোম্পানির পেনশনভুক্ত অধিকর্তায় পরিণত হয়।

৩. নবাব হাতের পুতুল দেওয়ানি লাভের পর বাংলার নবাব এখন কোম্পানির হস্ত পুত্তলিকায় বা হাতের পুতুলে পরিণত হয়। কারণ নবাবের নিজস্ব কোনো সৈন্য নেই। কোম্পানি নবাবের শাসন পরিচালনার জন্য যে পরিমাণ অর্থ দেবে এর অতিরিক্ত আর কোনো আয় ছিল না।

৪. কোম্পানি শাসন প্রতিষ্ঠা: ১৭৬৫-১৭৭২ সাল পর্যন্ত কোম্পানির পরোক্ষ শাসন ব্যবস্থায় জনগণের অসন্তোষ ও চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এজন্য কোম্পানির কর্মচারীরা বহুলাংশে দায়ী – ছিল। ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭২ সালে কোম্পানির গভর্নর নিযুক্ত হয়ে নবাবকে বাংলার শাসন দায়িত্ব থেকে সম্পূর্ণরূপে অব্যাহতি = দেন এবং তার জন্য বার্ষিক ১৬ লক্ষ টাকা ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করেন। এভাবে ইংরেজরা প্রকাশ্যভাবে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শাসকরূপে এদেশের রাজনৈতিক জীবনে অবতীর্ণ হয়।

৫. কোম্পানির বিচার ক্ষমতা : কোম্পানি দেওয়ানি লাভ করার ফলে দেওয়ানের কর্তব্য কার্যের মধ্যে রাজস্ব আদায় ছাড়াও দেওয়ানি মামলার বিচারের দায়িত্ব ছিল বলে কোম্পানি সারা বাংলার বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এতে কোনো বাধা ছিল না।

(খ) দেওয়নি লাভের অর্থনৈতিক গুরুত্ব : কোম্পানি কর্তৃক দেওয়ানি লাভের অর্থনৈতিক গুরুত্ব নিম্নরূপ:

১. কোম্পানির আর্থিক সমস্যার সমাধান: দেওয়ানি লাভের মাধ্যমে বাংলার রাজস্বের উপর কোম্পানি ভাগ বসানোর ফলে ইংরেজদের আর্থিক সমস্যা অনেকটা মিটেছিল। কারণ ইংল্যান্ডে তখন যুদ্ধবিগ্রহের দরুন যে অর্থের টানাটানি পড়েছিল তার ফলে মাতৃদেশ থেকে অর্থ আমদানি করে এ দেশে কোম্পানির পক্ষে ব্যবসায় বাণিজ্য চালানো সম্ভবপর ছিল না। দেওয়ানি লাভ করার ফলে এ সমস্যার সমাধান হয়।

২. বাংলার কৃষি অর্থনীতি ধ্বংস: দেওয়ানি লাভের পর কোম্পানি রাজস্ব আদায়ের যে নীতি গ্রহণ করে তার ফলে কৃষি অর্থনীতিতে ধস নামে। প্রত্যেক বছর রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি ও রাজস্ব আদায়ের কঠোরতা সহ্য করতে না পেরে অনেক কৃষক তাদের কৃষিকাজ পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়। এক কথায় কোম্পানির রাজস্বনীতি বাংলার কৃষি অর্থনীতির ধ্বংস বহুলাংশে ত্বরান্বিত করে।

৩. কোম্পানির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন: প্রতিবছর রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি ও তা কঠোরভাবে আদায় এবং দেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার মাধ্যমে কোম্পানির অর্থনৈতিক সচ্ছলতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। কোম্পানির মালিক ও কর্মচারীরা এদেশে সম্পদ লুণ্ঠনের নীতি গ্রহণ করে এবং এদেশীয় সম্পদ স্বল্পমূল্যে ক্রয় করে অধিক মূল্যে বিদেশে বিক্রির নীতি গ্রহণ করে। বস্তুত দেওয়ানি লাভ কোম্পানির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করে এবং আর্থিক সচ্ছলতার দরুন সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করে ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠার প্রয়াস পায়।

৪. বাংলার ব্যবসায়ী ও বণিক শ্রেণির দুর্দশা: কোম্পানি কর্তৃক দেওয়ানি লাভের ফলে বাংলার ব্যবসায়ী ও বণিক শ্রেণির সমাধি রচিত হয়। কোম্পানির কর্মচারীরা ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত হয়। শুধুমাত্র বাংলার অভ্যন্তরে নয়, তারা বাংলার বাইরেও তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারিত হয়। ফলে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে * বাংলার অনেক ব্যবসায়ী ও বণিক নিজেদের পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশা অবলম্বন করতে বাধ্য হয়। আর যারা স্ব-ব্যবসায় টিকেছিল তারা সীমাহীন দুরবস্থায় নিপতিত হয়েছিল।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, মুঘল আমলে ইংরেজ বণিকরা বাংলায় বাণিজ্য করার জন্য আসেন এবং ১৭৫৭ সালে
পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করার পথ সৃষ্টি করেন এবং ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধের মাধ্যমে সব বাধাকে চিরতরে দূর করেন। কিন্তু বাধা দূর হলেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ না করে এক অভিনব কৌশল অবলম্বন করে ভারতীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন। আর এই অভিনব কৌশল হলো রাজস্ব তথা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ। এ দেওয়ানি লাভের মধ্যদিয়ে কোম্পানি ভারতের অঘোষিত সরকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।