এরিস্টটলের আইনের শাসনের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।

অথবা, এরিস্টটলের আইনের শাসনের ধরন তুলে ধর।

অথবা, এরিস্টটলের আইনের শাসন ব্যাখ্যা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞানের জনক মহান গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে যেসব মতবাদ প্রদান করেন তার মধ্যে আইনের শাসন বা নিয়মতান্ত্রিকতাবাদ একটি উল্লেখযোগ্য মতবাদ হিসেবে স্বীকৃত। এরিস্টটল তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের আলোচনায় কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিমণ্ডলীকে গুরুত্ব দেয়ার পরিবর্তে আইনের উপর অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করেছেন। কারণ এরিস্টটল মানবজীবনের শুদ্ধতার জন্য আইনের শাসনকে অত্যাবশ্যক বলে মনে করেন। এজন্য তিনি বলেছেন, “Man when perfected, is the best of all animals but when separated from law and justice, it is worst of all.” তাঁর মতে, রাষ্ট্র শাসনের ক্ষেত্রে আইনই হবে সার্বভৌম।

এরিস্টটলের আইনের শাসনের বৈশিষ্ট্য: এরিস্টটলের আইনের শাসনকে বিশ্লেষণ করলে এর কতকগুলো বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যথা:

১. সাংবিধানিক আইসের প্রাধান্য: এরিস্টটল তাঁর শিক্ষাগুরু প্লেটোর দার্শনিক রাজার শাসনকে বাতিল করেছেন। কারণ তিনি ব্যক্তিনির্ভর জ্ঞানের সার্বভৌমত্ব অপেক্ষা সাংবিধানিক আইনকে অনেক বেশি শ্রেষ্ঠ বলে মনে করেন। প্লেটো যে আইনকে দুর্ভাগ্যজনক প্রয়োজন মনে করেছেন এরিস্টটল সেটাকে একান্তই স্বাভাবিক বলে মত পোষণ করেছেন।

২. আইন নিরপেক্ষ: আইনের মধ্যে রয়েছে নৈর্ব্যক্তিক গুণ, যার দর্শন ব্যক্তির মধ্যে মেলে না, আইন নিরপেক্ষ, কিন্তু ব্যক্তি নিরপেক্ষ হতে পারে না, রাষ্ট্রীয় আইন বা সংবিধান সকল ব্যক্তির ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য।

৩. আইনের নিজস্ব গতি: আইন তার নিজস্ব গতিতে পরিচালিত হয়। আইনের একটি নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য ও মর্যাদাবান সত্তা রয়েছে। আইনের নিরপেক্ষ ও নিরাসক্ত কর্তৃত্ব বিচারকের আসনে অধিষ্ঠিত হয় না। কিন্তু বিচারকের বিচার ক্ষমতাকে নিয়ম বা আইন অনুসারে চলতে বাধ্য করে।

৪. মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ: এরিস্টটল মনে করেন, নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের সংরক্ষণ হলো নিয়মতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। একমাত্র সাংবিধানিক আইনের সার্বভৌমত্বই জনগণের মৌলিক অধিকারকে নিশ্চয়তা দিতে পারে। তিনি বলেছেন, আইনের সার্বভৌমত্ব ছাড়া নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।

৫. মানুষের পশু চরিত্র নিয়ন্ত্রণ: মানুষের মধ্যে পশু চরিত্র বা পশু আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতিশাস্ত্রের বাণী যথেষ্ট
নয়। তার জন্য আইনের শক্তি প্রয়োগ করা বাঞ্ছনীয়।

৬. আইনের সমষ্টি সংবিধান: আইন ও সংবিধান এরিস্টটলের নিকট অভিন্ন। রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত আইনের সমষ্টিই হলো সংবিধান। আইনের অনুপস্থিতি স্বেচ্ছাচারিতার জন্ম দেয়। নিঃস্বার্থ নিরপেক্ষতা রক্ষার জন্য আইনকে অবশ্যই সার্বভৌম হতে হবে।

৭. আইনের সার্বভৌমত্ব: এরিস্টটল মনে করেন, আইন ও সরকারের মধ্যে সমন্বয় সম্পর্ক থাকবে। তিনি আইনের সার্বভৌমত্ব কামনা করে সরকারকে আইনের সেবক হিসেবে চিহ্নিত করতে চান। আইনের সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করে কোন পদ্ধতির সরকার নিরঙ্কুশ হতে পারে না, তা সে গণতন্ত্র বা অভিজাততন্ত্র যাহোক না কেন।

৮. আইন চুক্তির বহিঃপ্রকাশ: আইন চুক্তির মাধ্যমে তৈরি করা হয়। এ চুক্তিতে মানুষের পারস্পরিক নিশ্চয়তার ইঙ্গিত রয়েছে। কতকগুলো প্রথার সমন্বয়ে সৃষ্ট আইনের লক্ষ্য হলো জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

৯. আইন সংবিধান ও সংবিধান নির্ভর: এরিস্টটল বলেছেন, আইন সার্বভৌম এবং সংবিধান নির্ভর হবে। সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আইন প্রণয়ন করা হবে। আর সংবিধানের প্রবণতা হলো শ্রেণিস্বার্থের দিকে ঝুঁকে পড়া। শ্রেণিস্বার্থ বা ব্যক্তিস্বার্থ যদি আইনের পবিত্রতার উপর হস্তক্ষেপ করে, তবে আইনটি কেবলমাত্র রক্ষাকবচ হিসেবে নাগরিকদের রক্ষা করতে পারে।

১০. আইন সার্বজনীন ও সমদর্শী: এরিস্টটল মনে করেন, আইন সার্বজনীন ও সমদর্শী। আইনের চোখে মানুষের কোন শ্রেণিভেদ নেই। আইনের শাসন ব্যক্তির শাসন অপেক্ষা অধিকতর শ্রেষ্ঠ। আইনকে সদ্‌গুণ হিসেবে বিচার করা হয়। সুতরাং রাষ্ট্র বা গোষ্ঠীর নৈতিক বিধান হিসেবে আইন সর্বোচ্চ কল্যাণ নির্ধারণ করে।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, যদিও এরিস্টটলের আইনের শাসন বা নিয়মতান্ত্রিকতাবাদের কতিপয় সমালোচনা রয়েছে, তথাপি রাজনৈতিক দর্শনে এরিস্টটলের আইনের শাসনের যথেষ্ট প্রভাব বা গুরুত্ব রয়েছে। কারণ এরিস্টটলের আইনের শাসন থেকেই বর্তমানের আইনের শাসন বা নিয়মতান্ত্রিকতাবাদের জন্ম। অধ্যাপক ডাইসি (Dicey) বলেছেন, “বর্তমানের আইনের শাসনের ভিত্তি হলো এরিস্টটলের আইনের শাসন।” কারণ তিনিই আইনের শাসনের উপর অত্যধিক গুরুত্বারোপ করেছিলেন। তাই বলা যায়, এরিস্টটলের আইনের শাসন সম্পর্কিত মতবাদ এক অনবদ্য অবদান।