অথবা, এরিস্টটলের নাগরিকত্বের গুণাবলিসমূহ ব্যাখ্যা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যেসব দার্শনিক মহাপুরুষ সাফল্যের গৌরবোজ্জ্বল আসনে অধিষ্ঠিত, গ্রিক দার্শনিক Aristotle নিঃসন্দেহ তাদের মধ্যে অন্যতম। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রতত্ত্বের ক্ষেত্রে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন তা অতুলনীয়। এরিস্টটলের বিখ্যাত গ্রন্থ হলো ‘The Politics.’ এ গ্রন্থের মধ্যে তাঁর রাষ্ট্র সম্পর্কিত যাবতীয় চিন্তার পূর্ণ বিকাশ সাধিত হয়েছে। Politics এর তৃতীয় খণ্ডে তিনি নাগরিকতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর নাগরিকতা বিষয়ক মতবাদ রাষ্ট্রদর্শনে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
নাগরিকদের গুণাবলি: এরিস্টটল নাগরিকত্বের কতকগুলো গুণাবলি আলোচনা করেছেন। নিম্নে সেগুলো আলোচনা করা হলো:
প্রথমত, নাগরিক যেমন শাসন করবে, তেমনি শাসিতও হবে। তিনি বলেছেন, শ্রমিক শ্রেণি রাষ্ট্রে বসবাস করবে ঠিকই, কিন্তু তারা অন্যের আদেশ পালন করবে।
দ্বিতীয়ত, একজন নাগরিককে নৈতিক দিক দিয়ে উন্নত হতে হবে। অন্যকথায়, একজন উত্তম নাগরিককে একজন উত্তম ব্যক্তি, শিক্ষিত ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি হতে হবে। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছেন যে, একজন উত্তম ব্যক্তি সে উত্তম নাগরিক নাও হতে পারেন।
তৃতীয়ত, নাগরিকত্ব বা নাগরিকতা লাভের আর একটি প্রয়োজনীয় গুণ হলো নাগরিককে সম্পত্তির অধিকারী হতে হবে। এর ফলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা একটু দৃঢ় হবে।
চতুর্থত, নাগরিক হতে হলে তাকে রাজনৈতিক কর্তব্য পালনের মাধ্যমে যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে। তিনি বলেছেন, শ্রমিক শ্রেণি রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য কিন্তু তাদেরকে নাগরিকত্ব দেয়া যাবে না। কারণ রাজনৈতিক কর্তব্য পালনের মাধ্যমে তারা যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারে না। একই কারণে স্ত্রীলোক, ছেলেমেয়ে, বিদেশি এবং বাণিজ্যের প্রতি অনুরাগী ব্যক্তিরা নগর রাষ্ট্রের নাগরিক হতে বঞ্চিত হবে।
পঞ্চমত, একজন নাগরিকের যথেষ্ট অবসর সময় থাকবে। তিনি মনে করেন মানবজীবন কাজকর্ম, আমোদপ্রমোদ এবং অবসর সময় নিয়ে সৃষ্ট। তিনি এখানে অবসর বলতে অবসন্ন সময়কে বুঝান নি, কিন্তু কাজকর্ম করার একটি বিশেষ সময়কে বুঝিয়েছেন। এ কাজকর্মের মাধ্যমে একটি মানুষ নিজেকে গুণে গুণান্বিত করতে পারে এবং ভালো চিন্তা করতে পারে। এ কাজকর্ম বলতে তিনি রাজনৈতিক সুদূর কল্পনা এবং জনগণের কাজকর্মকে বুঝিয়েছেন।
ষষ্ঠত, একজন নাগরিক অবশ্যই শিক্ষিত ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি হতে হবে। তিনি রাষ্ট্রীয় কাজে যেমন দক্ষ হবেন। তেমনি নৈতিকতার দিক থেকেও উন্নত গুণের অধিকারী হবেন। এ সম্পর্কে এরিস্টটলের অভিমত হলো: “Perhaps to be a good man is not alleys the same thing as to be good citizen.”
সপ্তমত, এরিস্টটলের মতে, সুনাগরিকতার জন্য অবসর অপরিহার্য। তাঁর মতে, নাগরিকরা সাংসারিক জীবনের ঝুঁকি ঝামেলার দ্বারা বিবৃত না হয়ে একাগ্রচিত্তে রাষ্ট্রের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করবে।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, এরিস্টটল তাঁর নাগরিকতা বিষয়ক ধারণায় অত্যন্ত গোঁড়ামির পরিচয় দিয়েছেন। ‘কেননা তিনি শুধু ধনিক শ্রেণির মধ্যে নাগরিকতাকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। নগর রাষ্ট্রকে সামনে রেখে প্রকাশিত এ মতবাদটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সম্পূর্ণরূপে প্রযোজ্য না হলেও অনেক ক্ষেত্রে এখনো প্রযোজ্য। বর্তমানকালেও রাষ্ট্রের সকলেই নাগরিক অধিকার লাভ করে না। যেমন- অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং মস্তিষ্কবিকৃত লোকদের ভোটদানের অধিকার নেই। বিদেশিদেরকেও নাগরিক বলা যায় না। তাই পরিশেষে বলা যায় যে, আধুনিক নাগরিকত্বের ধারণার সাথে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অসঙ্গতি থাকলেও প্রাচীন নগর রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এ মতবাদটি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।