অথবা, এরিস্টটলের সম্পত্তি মতবাদ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, এরিস্টটলের সম্পত্তি তত্ত্বটি বর্ণনা কর।
উত্তর: ভূমিকা: রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে যেসব দার্শনিকের নাম চিরস্মরণীয় তাদের মধ্যে গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল অন্যতম। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রতত্ত্বের ক্ষেত্রে তিনি যেসব তত্ত্ব প্রদান করেছেন তা বর্তমান কালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে তিনি যেসব তত্ত্ব প্রদান করেছেন, তার মধ্যে সম্পত্তি তত্ত্ব একটি ব্যতিক্রমী তত্ত্ব। কেননা এরিস্টটলের গুরু প্লেটো যেখানে সম্পত্তির যৌথমালিকানার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন, সেখানে তিনি সম্পত্তির ব্যক্তিমালিকানার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। সম্পত্তি সম্পর্কে Aristotle তাঁর বিখ্যাত ‘The Politics’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘সম্পত্তি হচ্ছে মানুষের কাছে প্রকৃতিগত। কেননা এর মাধ্যমে ব্যক্তি নৈতিক উৎকর্ষতা লাভে সক্ষম হয়। সম্পত্তির ভোগদখল থেকে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করার অর্থ হচ্ছে তার ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথকে রুদ্ধ করা।”
এরিস্টটলের সম্পত্তি তত্ত্ব: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক মহান গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল তাঁর বিখ্যাত ‘The Politics’ গ্রন্থে রাষ্ট্রের নাগরিকদের অবস্থান সম্পর্কে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সম্পত্তির অধিকার ও মালিকানা নিয়ে আলোচনা করেছেন, যা তাঁর সম্পত্তি তত্ত্ব নামে পরিচিত। তিনি তাঁর মতবাদ সম্পর্কে প্রকারভেদ ও সম্পদ সংগ্রহের বিভিন্ন উৎস সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, প্রকৃতি সকল জীবের জীবিকা অর্জনের জন্য বিভিন্ন প্রকার সম্পদ সৃষ্টি করে দিয়েছেন এবং সেগুলোকে সংগ্রহ করে জীবনধারণ করতে বলেছেন। কেননা সম্পত্তি আহরণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সম্পত্তি ছাড়া মানুষের নৈতিক উৎকর্ষতা লাভ সম্ভব হয় না। তাছাড়া মানুষের জীবিকানির্বাহের জন্য সম্পত্তিই একমাত্র সম্বল। নিম্নে এরিস্টটলের সম্পত্তি তত্ত্ব বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:
১. ব্যক্তিগত সত্তার উপলব্ধির জন্য সম্পত্তি: Aristotle তাঁর বিখ্যাত ‘The Politics’ গ্রন্থে বলেছেন, মানুষের সংসারধর্ম পালন তথা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান প্রভৃতি মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকা আবশ্যক। কারণ ব্যক্তিগত সম্পত্তির মাধ্যমে একজন মানুষের ব্যক্তিগত সত্তার উপলব্ধি অর্জন সম্ভব হয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তি না থাকলে জীবন নিরানন্দ হয়ে পড়ে। তাই তিনি ব্যক্তিগত সম্পত্তির উপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
২. অর্থের কলাকৌশল নির্ধারণ: গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের মতে, “সম্পদ সংগ্রহ এক প্রকার অর্থের কলাকৌশল নির্ধারণ করা।” অর্থাৎ প্রাকৃতিক বা অপ্রাকৃতিক উভয় অর্থনৈতিক কার্যাবলির দ্বারা সম্পদ সংগ্রহ করাকে বুঝায়। প্রাকৃতিক অর্থ সংগ্রহ ব্যবস্থা বলতে তিনি কৃষি, পশুপালন, মৎস্য চাষ, শিকার, লুণ্ঠন, ব্যবসায় বাণিজ্য প্রভৃতিকে বুঝিয়েছেন। আর অপ্রাকৃতিক অর্থব্যবস্থা বলতে তিনি শুধু সঞ্চয়ের জন্য অর্থ সংগ্রহ ব্যবস্থাকে বুঝিয়েছেন। মূলত সম্পদ সংগ্রহের মূল উদ্দেশ্য হলো অর্থ উপার্জন করা।
৩. সম্পত্তির সীমা: এরিস্টটল বলেছেন, “প্রত্যেক বাক্তির সম্পত্তির নির্দিষ্ট সীমা থাকা আবশ্যক।” একজন ব্যক্তি বা পরিবারের কতটুকু সম্পত্তির প্রয়োজন, তা নির্ধারণ করা যায় তার প্রয়োজন বা চাহিদার দ্বারা। ব্যক্তির প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পত্তি ব্যক্তি মানুষকে লোডলালসায় নির্লিপ্ত করে, তাকে স্বৈরাচারী মানসিকতায় পরিণত করে এবং নৈতিক স্খলন ও নানা অরাজক পরিস্থিতির দিকে ধাবিত করে। আবার সম্পদহীনতা দারিদ্রদ্র্য ও অসাম্যের সৃষ্টি করে। তাই এরিস্টটল সম্পত্তির বিলোপ বা অতিরিক্ত সম্পত্তি লাভ এ দু’টিরই বিরোধিতা করে সম্পত্তি নির্ধারণের পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।
৪. খাদ্যসামগ্রী: এরিস্টটল খাদ্যসামগ্রীকে সম্পদের একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে অভিহিত করেছেন। কেননা প্রত্যেকটি জীবের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য অপরিহার্য। তিনি প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে প্রকৃতি হতেই খাদ্য সংগ্রহকারী বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণির কথা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, একটি পেশা বা বৃত্তি জীবিকার প্রয়োজন মিটানোর পক্ষে যথেষ্ট না হলে অন্যান্য পেশা অবলম্বন করে অভাবটুকু পূরণ করবে। যেমন- কৃষকরা কৃষি, মেষপালন, মৎস্য চাষ বা শিকার ইত্যাদি করে জীবিকানির্বাহ করতে পারে।
৫. মানবকল্যাণের জন্য সম্পত্তি: এরিস্টটল বলেছেন, “শুধু অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা ও সম্পদ আহরণের জন্য সম্পত্তি প্রয়োজন তা নয়, বরং নাগরিকদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে নৈতিক, মানবিক ও শারীরিক উন্নতি বিধানের জন্যও সম্পত্তি প্রয়োজন।” তিনি সম্পদ অর্জনকে রাষ্ট্রের নাগরিকদের নৈতিকতা অর্জনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে চেয়েছেন। মূলত মানবকল্যাণের জন্যই সম্পত্তি প্রয়োজন।
৬. সম্পত্তি রক্ষার ক্ষেত্রে: এরিস্টটল তাঁর সম্পত্তি তত্ত্বে যৌথমালিকানার পরিবর্তে ব্যক্তিগত মালিকানার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। কেননা সম্পত্তিতে যৌথমালিকানা থাকলে তার প্রতি অবহেলা ও অমনোযোগ বৃদ্ধি পাবে। ব্যক্তিগতভাবে তা অর্জনের সুবিধা না থাকায় তাতে আগ্রহ ও একাগ্রতার অভাব দেখা দেয়। তাই সম্পত্তি রক্ষার ব্যবস্থা হিসেবে ব্যক্তিগত মালিকানাকেই তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন।
৭. খনিজ সম্পদ আহরণ: এরিস্টটল তাঁর ‘The Politics’ গ্রন্থে সম্পত্তি তত্ত্ব আলোচনা করতে গিয়ে মাটির নিচ থেকে খনিজ সম্পদ আহরণের কথা বলেছেন। বিভিন্ন খনিজ সম্পদ আহরণ ও বিনিময়ের মাধ্যমে ব্যক্তি তার চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবে, যা ব্যক্তির নৈতিক উৎকর্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, এরিস্টটলের সম্পত্তি তত্ত্বের কিছু সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও পরবর্তীকালের রাষ্ট্রচিন্তায় এর বিশেষ প্রভাব পড়ে। অনেকে মনে করে যে, সম্পত্তি সম্পর্কে জন লকের যে প্রসিদ্ধ মতবাদ তাও মূলত এরিস্টটলের সম্পত্তি তত্ত্ব থেকে উদ্ভূত। অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন, যদি এরিস্টটলের পরবর্তী সময়ে তার সম্পত্তি তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব হতো, তাহলে পৃথিবীর আজকের চিত্র ভিন্ন হতো। ঔপনিবেশিকতা বা সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা কোন দেশ, সমাজ, মানুষ নিষ্পেষিত না হয়ে, বরং একটি সাম্যবাদী কল্যাণকামী বিশ্ব সৃষ্টি হতো। কেননা তিনি সম্পত্তির সমবণ্টনের দিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করেছিলেন। তাই এরিস্টটলের সম্পত্তিতত্ত্বের গুরুত্ব আজও স্বীকৃত।