এরিস্টটলের সর্বোত্তম বাস্তবধর্মী রাষ্ট্র কী? আলোচনা কর।

অথবা, এরিস্টটলের সর্বোত্তম বাস্তবধর্মী রাষ্ট্রে কি মধ্যবিত্তের প্রাধান্য বজায় থাকবে? ব্যাখ্যা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক Aristotle ৩৮৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে এথেন্সের অন্তর্গত স্ট্যাগিরা নামক ক্ষুদ্র ঔপনিবেশিক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাস্তববাদী দার্শনিক এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক হিসেবে ইতিহাসে পরিচিত। মার্কসবাদী দর্শনের অন্যতম প্রবক্তা ফ্রেডারিক এঙ্গেলস এরিস্টটলকে তাই প্রাচীন বাস্তববাদী জ্ঞানদর্শনের শীর্ষমণি বলে আখ্যায়িত করেন। রাষ্ট্র ও রাজনীতি বিষয়ে এরিস্টটল কতকগুলো গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘The Politics’, ‘The Constitutions’, ‘The Constitution of Athens’ উল্লেখযোগ্য। তবে তাঁর রচনাবলির মধ্যে The Politics ই শ্রেষ্ঠ। আর এ Politics এর মধ্যে যেসব বিষয়ের আলোকপাত করা হয়েছে তার মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো সর্বাপেক্ষা বাস্তবধর্মী রাষ্ট্র।

এরিস্টটলের সর্বোত্তম বাস্তবধর্মী রাষ্ট্র: এরিস্টটল Politics গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে মধ্যপন্থি গণতন্ত্রের উল্লেখ করেন। তিনি কোন বাস্তব অবস্থায় কি ধরনের শাসনব্যবস্থা কার্যকরী হবে তা বিশ্লেষণ করে বলেছেন, যে কোন শাসনব্যবস্থার সাফল্য কতকগুলো বাস্তব অবস্থার উপর নির্ভরশীল। যে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা বাস্তবভিত্তিক এবং যার মাধ্যমে অধিকাংশ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত ও কার্যকরী করা সম্ভব, তাকেই এরিস্টটল সর্বাপেক্ষা বাস্তবসম্মত রাষ্ট্র বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর এ সর্বাপেক্ষা বাস্তবসম্মত শাসনব্যবস্থাকেই এরিস্টটল Polity বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং তিনি সরকারের স্বাভাবিক রূপের মধ্যে ‘পলিটি’ (মধ্যপন্থা ধাঁচের সরকার ব্যবস্থা) উত্তম ও একে বাস্তবে পরিণত করা অপেক্ষাকৃত সহজ বলে মত প্রকাশ করেছেন। এরিস্টটল সমর্থিত পলিটি সম্পর্কে অভিমত শক্ত করতে গিয়ে J. P. Suda বলেছেন যে, “পলিটিকে এমন এক ধরনের গণতন্ত্ররূপে অভিহিত করা যায়, যা ধনিব স্ত্রের নিকটবর্তী। আবার তাকে এমন এক ধরনের ধনিক তন্ত্র বলে অভিহিত করা যায়, যা গণতন্ত্রের নিকটবর্তী।”

বস্তুত এরিস্টটল ‘পলিটিতে’ গণতন্ত্রের ও অভিজাত তন্ত্রের ত্রুটিবিচ্যুতি পরিহার করার চেষ্টা করেন। এতে সম্পদের অতিপ্রাচুর্য ও দারিদ্র্যের মারাত্মক কশাঘাতকে পরিহার করে দু’টি বিপরীতমুখী স্রোতধারার সমন্বয় সাধন করে মধ্যম – শ্রেণির অবস্থানের উল্লেখ করা হয়। তার এ পদ্ধতিই নিয়মতান্ত্রিক সরকার নামে পরিচিত।

সর্বোত্তম বাস্তবধর্মী রাষ্ট্র বিশ্লেষণে মানবজীবন পদ্ধতি: মানুষের পক্ষে কিরূপ জীবনযাপন সর্বাপেক্ষা শ্রেয় অথবা কোন ধরনের শাসনব্যবস্থা বিশেষ উপযোগী এ সম্পর্কে মতামত প্রকাশকালে এরিস্টটল বলেছেন যে, সকলের জন্য যেরূপ শিক্ষাব্যবস্থা ও শাসনতন্ত্র এবং যেরূপ জীবনযাপনসুলভ, তাই সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও সুখী জীবন। তাঁর মতে, নৈতিক উৎকর্ষ কোন চরম পরিণতি নয়, এটা মাঝামাঝি স্থানে প্রকাশ পায়। কাজেই বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করলে দেখা যাবে মধ্যম ধরনের জীবনযাপনই সর্বোত্তম জীবন লাভের পন্থা।

মধ্যবিত্তের প্রাধান্য ও নিয়মতান্ত্রিক বাস্তব রাষ্ট্র: সুন্দর নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থা তখনই কায়েম হতে পারে, যখন রাষ্ট্রে মধ্যবিত্ত নাগরিকের সংখ্যা বেশি হবে আর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে তো কথাই নেই। ফলে অন্য কোন শ্রেণির পক্ষে অধিকতর প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা থাকবে না। শাসক শ্রেণির হাতে পরিমিত ধন থাকাটাকে এরিস্টটল সৌভাগ্য বলে মনে করেন না। যেহেতু ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের উগ্র শ্রেণিবিভাগ দেখা যায়, ফলে সরকারের স্থিতিশীলতার অভাব ঘটে। কারণ সর্বদাই রাষ্ট্রের রাজনৈতিক বিরোধ ও সামাজিক বিরোধ লেগেই থাকে। সেক্ষেত্রে হয় ধনীরা নয় দরিদ্ররা ক্ষমতার অধিকারী। ধনীরা স্থাপন করে কুলীনতন্ত্র, আর দরিদ্ররা করে গণতন্ত্র। এরিস্টটল তাঁর নিয়মতান্ত্রিক সরকারকে সর্বোত্তম সরকার মনে করেন। কুলীনতান্ত্রিক অথবা গণতান্ত্রিক’ যেমন সরকারই হোক না কেন, সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থার লক্ষ্য হবে এমনভাবে আইন প্রণয়ন করা, যাতে সমাজের ভারসাম্য রক্ষণকারী মধ্যবিত্তের প্রাধান্য থাকে। তাহলে ধনীর অন্যায় প্রতিপত্তি অথবা দরিদ্রের অবাঞ্ছিত প্রাধান্য বহুলাংশে হ্রাস পায়।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে এরিস্টটল তার পলিটিক্স গ্রন্থের সপ্তম ও অষ্টম অধ্যায়ে সর্বোত্তম রাষ্ট্র নিয়ে আলোচনা করেছেন। আদর্শ রাষ্ট্র বা সর্বোত্তম রাষ্ট্র সম্পর্কে এরিস্টটলের ধারণা তা অবশ্যই সদগুণ দ্বারা শাসিত হতে হবে এবং শ্রেষ্ঠ নাগরিক তা পরিচালনা করবে।