এরিস্টটলের সর্বোত্তম রাষ্ট্র বা সর্বোত্তমকার্যকর রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কর।

অথবা, এরিস্টটলের সর্বোত্তম রাষ্ট্র বা সর্বোত্তম কার্যকর রাষ্ট্রের মধ্যে ‘বৈসাদৃশ্যগুলো আলোচনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে যেসব মনীষী চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁদের মধ্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটলের নাম সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য। এরিস্টটল রাজনীতিকে একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন বিজ্ঞানরূপে আখ্যায়িত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে, প্রাচ্যের রাজনীতি এরিস্টটলের হাত দিয়ে শুরু হয়। এরিস্টটল যেসব গ্রন্থ রচনা করেছেন, সেগুলোর মধ্যে ‘The Politics’ সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য। ‘The Politics’ এরিস্টটলের মূলমন্থ। কেননা এ গ্রন্থের মধ্যে যাবতীয় রাষ্ট্রচিন্তার পূর্ণ বিকাশ সাধিত হয়েছে। “The Politics’ গ্রন্থেই এরিস্টটল সরকারের শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছেন।

সর্বোতম রাষ্ট্র ও সর্বোত্তম কার্যকর রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য: এরিস্টটল তাঁর ‘The Politics’ গ্রন্থের সপ্তম ও অষ্টম অধ্যায়ে আদর্শ বা সর্বোত্তম রাষ্ট্র ও সর্বোত্তম কার্যকর রাষ্ট্রের ধারণা ব্যক্ত করেছেন। এরিস্টটল তাঁর এ গ্রন্থে সর্বোত্তম রাষ্ট্র ও সর্বোত্তম কার্যকর রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করেছেন, তা নিম্নে আলোচনা করা হলো:

সর্বোত্তম রাষ্ট্র: এরিস্টটলের মতে, “রাজতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্র দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রই সর্বোত্তম রাষ্ট্র।” কারণ এতে কয়েকজন জ্ঞানীগুণী, শিক্ষিত ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তির সুচিন্তিত মতামতের ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন করা হয়। আর এ ধরনের আইনের সার্বভৌমত্বভিত্তিক প্রশাসন জনগণের সার্বিক কল্যাণ সাধন করতে পারে এবং তার আদর্শে জনগণের লক্ষ্যচ্যুত হয় না। এ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদরা সর্বদা প্রজ্ঞাবানদের শাসনকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তবে এরিস্টটল এ ধারণাও পোষণ করেছেন যে, রাজতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্র দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্র সর্বোত্তম রাষ্ট্র, কিন্তু রাজতন্ত্র ও অভিজাতন্ত্রের জন্য যে সদ্‌গুণাবলি ও শর্তাদি প্রয়োজন তা বাস্তবে পাওয়া দুষ্কর। তাছাড়া সকলের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যে একই রকম হবে এমনটাও নিশ্চিত করে বলা যায় না।

সর্বোত্তম কার্যকর রাষ্ট্র: এরিস্টটল মধ্যবিত্তের শাসন বা Polity কে সর্বোত্তম বা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ শাসনতন্ত্র বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, শাসনক্ষমতা যদি বিত্তবানদের হাতে ন্যস্ত থাকে তবে তারা দরিদ্রদেরকে শোষণ করবে এবং দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হবে। আবার শাসনক্ষমতা যদি দরিদ্র জনসাধারণের হাতে ন্যস্ত থাকে, তবে তারা বিত্তবানদের সম্পদ লুটে নেয়ার চেষ্টা করবে এবং এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় দ্বন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী। এজন্য এরিস্টটল এ দুই পরস্পরবিরোধী শ্রেণির মধ্য থেকে একমাত্র মধ্যবিত্ত শ্রেণি দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রকে সর্বোত্তম কার্যকর রাষ্ট্র বলেছেন। Polity বলতে তিনি এমন এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির কথা বলেছেন, যারা বিদ্বান, ন্যায়নিষ্ঠা, সচ্ছল ও সবদিক দিয়ে সুসংহত। তাঁর মতে, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে স্থায়িত্বের প্রবণতা বেশি। তারা যেমন গরিবের মতো অপরের সম্পত্তি কামনা করে না, ঠিক তেমনি অপরের সম্পত্তিও গ্রাস করে না। এজন্য তাদের জীবনযাত্রায় ঝুঁকি কম। তারা যেমন ষড়যন্ত্র করে না তেমনি যড়যন্ত্রের স্বীকারও হয় না। এজন্য তিনি মধ্যবিত্তের শাসনব্যবস্থা অর্থাৎ Polity কেই সর্বোত্তম রাষ্ট্র বলে অভিহিত করেছেন। এরিস্টটলের সর্বোত্তম রাষ্ট্র ও সর্বোত্তম কার্যকর রাষ্ট্রের পার্থক্যসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো:

১. সংজ্ঞাগত পার্থক্য: এরিস্টটলের সর্বোত্তম রাষ্ট্র ও সর্বোত্তম কার্যকর রাষ্ট্রের মধ্যে সংজ্ঞাগত পার্থক্য রয়েছে। যেমন- যে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কতিপয় শিক্ষিত, ন্যায়বান ও জ্ঞানীদের সুচিন্তিত মতামতের ভিত্তিতে পরিচালিত হয় তাই সর্বোত্তম রাষ্ট্র। অন্যদিকে, যে রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা মধ্যবিত্তের যারা পরিচালিত হয় তাকে সর্বোত্তম কার্যকরী রাষ্ট্র বলে।

২. সংখ্যাগত পার্থক্য: সংখ্যাগত দিক দিয়েও উভয় প্রকার রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। সর্বোত্তম রাষ্ট্রে কতিপয় ব্যক্তির মতামতের মাধ্যমে আইন প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু মধ্যতন্ত্রে এ রকম কতিপয় ব্যক্তির শাসন পরিলক্ষিত হয় না।

৩. জনপ্রিয়তার পার্থক্য: Polity বা মধ্যতন্ত্র আধুনিক, বিশ্বের একটি গ্রহণযোগ্য ও সুচিন্তিত শাসনব্যবস্থা। এ শাসনব্যবস্থা সর্বজনস্বীকৃত। পক্ষান্তরে, সর্বোত্তম রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ধনী ও অভিজাতদের শাসন পরিলক্ষিত হয়। এজন্য মধ্যতন্ত্রের জনপ্রিয়তা ধনী ও অভিজাতন্ত্রের চেয়ে অনেক বেশি।

৪. আভিজাত্যের পার্থক্য: সর্বোত্তম রাষ্ট্র মূলত অভিজাততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। অপরদিকে, সর্বোত্তম কার্যকরী রাষ্ট্র হলো মধ্যতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। এ রাষ্ট্রে আভিজাত্যের অস্তিত্ব তেমন পরিলক্ষিত হয় নি।

৫. জীবনযাত্রার ঝুঁকির ক্ষেত্রে: সর্বোত্তম কার্যকর রাষ্ট্র মধ্যবিত্তের শাসনব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত হয়। এরিস্টটলের মতে, মধ্যবিত্তরা বিধান, ন্যায়নিষ্ঠা, সচ্ছল ও সবদিক দিয়ে সুসংহত। তাঁর মতে, তারা গরিবের সম্পত্তি গ্রাস করে না। তারা যড়যন্ত্র করে না আবার যড়যন্ত্রের স্বীকারও হয় না। এজন্য তাদের জীবনের ঝুঁকি কম। অন্যদিকে, সর্বোত্তম রাষ্ট্র যাদের দ্বারা পরিচালিত হয় তাদের জীবনযাত্রার ঝুঁকি বেশি।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, এরিস্টটল শাসকের গুণ, ন্যায়নিষ্ঠা, সততা ও সংখ্যার ভিত্তিতে সর্বোত্তম রাষ্ট্র ও সর্বোত্তম কার্যকর রাষ্ট্রের পার্থক্য নির্ণয় করেছেন। এরিস্টটল সরকারের শ্রেণিবিভাগ, সর্বোত্তম রাষ্ট্র ও সর্বোত্তম কার্যকর রাষ্ট্র সম্পর্কে যে আলোচনা করেছেন, তা তাঁর বাস্তবচিন্তার ফসল। তিনি তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের পরিকল্পনায় সকল জটিলতা এবং চরমতাকে পরিহার করার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেছেন, “চরম অবস্থা পরিহার করা সম্ভব না হলে কোন রাষ্ট্রই সঠিকভাবে কার্যকরী ও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। আর তাই তিনি Polity কে তাঁর আদর্শ বা সর্বোত্তম কার্যকরী রাষ্ট্রের সঠিক গঠনতন্ত্র বলে উল্লেখ করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি Polity কে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ শাসনতন্ত্র বলেও উল্লেখ করেছেন।