“এরিস্টটল যেসব বিষয়ের উপর ভিত্তি করে উত্তম ব্যক্তির শাসন অপেক্ষা উত্তম আইনের শাসনকে সর্বোত্তম বলেছেন” ব্যাখ্যা কর।

অথবা, এরিস্টটলের মতবাদে যেসব ধারণার উপর ভিত্তি করে উত্তম ব্যক্তির শাসন অপেক্ষা উত্তম আইনের শাসনকে সর্বোত্তম বলে প্রাধান্য দিয়েছেন তা আলোচনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: রাষ্ট্রে সাংবিধানিক শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি ছিল, তা হলো উত্তম মানুষ দ্বারা শাসনকার্য সম্পাদন করা উত্তম, না উত্তম আইন দ্বারা শাসন কার্যসম্পাদন করা উত্তম। এরিস্টটল অভিমত প্রকাশ করেন যে, উত্তম বা আদর্শ রাষ্ট্রের লক্ষণ হলো আইনের সার্বভৌমত্ব বা Sovereignty of law.

আইনের গুরুত্বের দিক দিয়ে বিচার করলে Plato এর আদর্শ রাষ্ট্র ও এরিস্টটলের আদর্শ বা উত্তম রাষ্ট্রের মধ্যে হাহ্যত কোন পার্থক্য দেখা যায় না। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, বাস্তবতার কঠোর প্রয়োজনে Plato তাঁর ‘Laws’ এর মধ্যে আইনের প্রাধান্যকে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁর নিকট এর প্রয়োজন ছিল নিতান্তই ‘দুর্ভাগ্যজনক’। তিনি মনে করেন, এ প্রয়োজনের উৎস ছিল মানবিক দুর্বলতা। কিন্তু এরিস্টটল যে আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছেন তার ভিত্তি Plato এর আদর্শ রাষ্ট্রের মতো স্বর্গলোকে প্রতিষ্ঠিত ছিল না বরং তাতে প্রতিষ্ঠিত ছিল বাস্তবতার নির্মম সত্য। এ কারণে তাঁর নিকট আইনের সার্বভৌমত্ব কোন দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হিসেবে প্রতিভাত না হয়ে প্রতিভাত হয়েছিল আদর্শ রাষ্ট্রের অপরিহার্য শর্ত হিসেবে।

আইনের শাসন: সাধারণ অর্থে আইনের শাসন হলো আইনের চোখে সকলেই সমান। কিন্তু ব্যাপক অর্থে আইনের শাসন হলো আইনের মাধ্যমে জ্ঞানের স্বাধীনতা রক্ষা করা। এ. ডি. ডাইসি (A. V. Dicey) বলেছেন, “…..no man is above the law, …….. every man, whatever be his rank or condition, is subject to the ordinary law of the realm and amenable to the jurisdiction of the ordinary tribunals.” আইনের দৃষ্টিতে একজন নাগরিক ও একজন সরকারি কর্মচারীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। ক্ষমতা, পদমর্যাদা ও সাধারণ অবস্থা নির্বিশেষে সকলেই দেশের সাধারণ আইনের অধীন। সুতরাং আইনের শাসন হলো আইনের সুপ্রতিষ্ঠিত প্রাধান্য। এ ধারণা অনুসারে আইন নাগরিকদের অধিকার ও স্বাধীনতার রক্ষক এবং শাসকের স্বৈরী ক্ষমতার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার উপায়।

উত্তম আইনের শাসন উত্তম ব্যক্তির শাসন অপেক্ষা অধিকতর বাঞ্ছনীয়: এরিস্টটল যেসব বিষয়ের উপর ভিত্তি করে উত্তম ব্যক্তির শাসন অপেক্ষা উত্তম আইনের শাসনকে সর্বোত্তম বলেছেন, সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো:

১. আইন নৈর্ব্যক্তিক গুণের অধিকারী: প্লেটো যেখানে দার্শনিক রাজার শাসনকে উত্তম বলেছেন, সেখানে এরিস্টটল দার্শনিক রাজার শাসনকে প্রত্যাখ্যান করে আইনের শাসনের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন রাজা বা শাসক হিসেবে একজন ব্যক্তি যত জ্ঞানী বা গুণসম্পন্ন অথবা সৎ হোন না কেন, আইন বা সংবিধানের উপর নির্ভর না করে তার পক্ষে শাসনকার্য পরিচালনা করা সম্ভবপর নয়। কেননা আইনের মধ্যে রয়েছে নৈর্ব্যক্তিক গুণ, যার দর্শন ব্যক্তির মধ্যে মেলে না। আইন নিরপেক্ষ কিন্তু ব্যক্তি নিরপেক্ষ হতে পারে না। রাষ্ট্রীয় আইন বা সংবিধান সকল ব্যক্তির ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য।

২. শৃঙ্খলতা বিধানে আইন: এরিস্টটল বলেছেন, “Man when perfected is the best of all animals but when separated from law and justice, it is the worst of all.” অর্থাৎ, বৃদ্ধতম মানুষ সকল জীবের থেকে শ্রেষ্ঠ। কিন্তু, আইন ও ন্যায় থেকে বিচ্ছিন্ন হলে সে হবে সবচেয়ে নিকৃষ্ট। তিনি আরও বলেছেন, “মানুষ উত্তেজনা ও স্বার্থের দ্বারা বিজিত বা সম্পূর্ণরূপে প্রভাবিত। তার প্রতি যতই চাপ দেয়া হোক না কেন তাকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ নয়।” আর এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আইনের প্রয়োজন পড়ে। মানুষের মধ্যে যে পশুত্ব লুকিয়ে রয়েছে তা সদুপদেশ দিয়ে বা বুদ্ধি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব, কেবল শাস্তির ভয় দেখানোর মাধ্যমে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সুতরাং সমাজের শৃঙ্খলা বিধানের জন্য উত্তম আইনের শাসন অপরিহার্য।

৩. মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ: এরিস্টটল মনে করেন, নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ হলো নিয়মতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। একমাত্র সাংবিধানিক আইনের সার্বভৌমত্বই জনগণের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দিতে পারে।

৪. আইন নৈতিক গুণে গুণান্বিত করে: Law follows its own course. অর্থাৎ, আইন তার আপন গতিতে পরিচালিত হয়। আইনের একটি নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য ও মর্যাদাবান সত্তা রয়েছে। এরিস্টটল বলেছেন, আইনের নিরাসক্ত কর্তৃত্ব ম্যাজিস্ট্রেটের উচ্চ আসন অলংকৃত করে না সত্য, কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেটের কর্তৃত্বকে এমন এক নৈতিক গুণে গুণান্বিত করে তোলে যা অন্য কোনভাবে লাভ করা সম্ভব নয়। আইনের কর্তৃত্বের মাধ্যমে ম্যাজিস্ট্রেটের বিচার ক্ষমতাকে নিয়ম বা আইন অনুসারে চলতে বাধ্য করে, যা তাকে নৈতিক গুণে গুণান্বিত করে তোলে।

৫. আইন নিঃস্বার্থ ও উত্তেজনাহীন যুক্তি: আইন হলো নিঃস্বার্থ ও উত্তেজনাহীন যুক্তি। অর্থাৎ যে যুক্তি কামনাবাসনার দ্বারা প্রভাবিত হয় না। এরিস্টটলের মতানুসারে, মানুষ মাত্রই আইন বা যুক্তির বাণীকে শোনার জন্য বাধ্য হতে পারে। কারণ আইনকে কার্যকর করার পিছনে শক্তি থাকে।

৬. স্বেচ্ছাচারিতা রোধে আইন: প্লেটোর দার্শনিক রাজার শাসন কোন আইনের বেড়াজালে সীমিত নয়। এরিস্টটল এ দার্শনিক রাজার শাসনের বিরোধিতা করে বলেছেন, রাজা লোভলালসার দ্বারা চালিত হতে পারেন। তিনি কল্যাণের নামে যথেচ্ছাচার চালাতে পারেন, যেহেতু তিনি আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নন। এরিস্টটল তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রে যাতে স্বৈরাচারী শাসন সৃষ্টি হতে না পারে, সেজন্য আইনের শাসনকে অপরিহার্য বলে উল্লেখ করেছেন।

৭. ব্যতির উৎকর্ষতার জন্য আইন: আইন দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের পরিণতি। সুতরাং, ব্যক্তির উৎকর্ষতার জন্য আইন কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। অধ্যাপক সেবাইন (Sabine) বলেছেন, “The growing stock of social intelligence is embodied in law and customs.” সুতরাং, রাষ্ট্রের নাগরিকদের উৎকর্ষতা বৃদ্ধির পিছনে আইনের শাসন অত্যন্ত জরুরি।

৮. আইন ছাড়া নিয়মতান্ত্রিক শাসন অসম্ভব: এরিস্টটলের মতে, আইনের সার্বভৌমত্ব ছাড়া নিয়মতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। কারণ নিয়মতান্ত্রিক সরকারের অপরিহার্য উপাদান হলো প্রজাবৃন্দের বৈধ পদমর্যাদা ও সম্মান এবং এ পদমর্যাদা একমাত্র আইনের সার্বভৌমত্বের মাধ্যমেই লাভ করা যায়।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, এরিস্টটল বিভিন্ন ধরনের যুক্তিতর্কের মাধ্যমে ব্যক্তি জীবন ও সামগ্রিক জীবনে আইনের অপরিহার্যতা প্রমাণ করেছেন। তিনি বলেছেন, একজন শাসক বা দার্শনিক রাজা ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে শাসন ক্ষেত্রে তাঁর মনোভাব প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে আইন অবিচল ও নিরপেক্ষ স্থানে অবস্থান করে। এতে জনগণের অধিকতর কল্যাণ সাধিত হয়। আর এ কারণেই এরিস্টটল বলেছেন, উত্তম ব্যক্তির শাসন অপেক্ষা উত্তম আইনের শাসন সর্বাধিক বাঞ্ছনীয়।