এলাহাবাদ চুক্তির পটভূমি উল্লেখ কর। বাংলায় কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠায় এ চুক্তির গুরুত্ব বর্ণনা কর।

অথবা, এলাহাবাদ চুক্তির ধারাসমূহ পরীক্ষা কর। বাংলায় কোম্পানি শাসন প্রতিষ্ঠায় এ চুক্তির গুরুত্ব বর্ণনা কর।

অথবা, এলাহাবাদ চুক্তির ধারা উল্লেখ করে র বাংলায় কোম্পানি শাসন প্রতিষ্ঠায় এ চুক্তির তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর।

উত্তর: ভূমিকা: কোম্পানির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের কথা চিন্তা করে দিল্লির সম্রাট শাহ আলম এবং অযোধ্যার ও সম্রাট সুজাউদ্দৌলার সঙ্গে মিত্রতা নীতি অনুসরণ করেন। ক্লাইভপ্রথমে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে অযোধ্যার নবাবের সঙ্গে এলাহাবাদের চুক্তি করেন। এলাহাবাদের সন্ধিতে রবার্ট ক্লাইভের অসাধারণ বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায়। ফলে কোম্পানি বাংলার দেওয়ানি বা রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা লাভ করেন।

এলাহাবাদ চুক্তির পটভূমি: ১৭৬৫ সালে সম্পাদিত এলাহাবাদ চুক্তির পটভূমি সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো-

১. পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভ: ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পরিকল্পিতভাবে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে রবার্ট ক্লাইভ বাংলা তথা ভারতবর্ষে ইংরেজ শক্তি প্রতিষ্ঠা করে। পলাশি যুদ্ধের আগে ইংরেজ কোম্পানি ছিল ভারতে অন্যান্য বণিক জাতির অন্যতম। কিন্তু পলাশির যুদ্ধের পর ক্লাইভএক পাশবিক নীতি গ্রহণ করে। এভাবে ক্লাইভ বাংলার দেওয়ানি লাভের সুযোগ খুঁজতে থাকে।

২. বক্সারের যুদ্ধ: নবাব মীর কাসিমের সময় এক পর্যয়ে কোম্পানির সাথে বিরোধ দেখা দেয়। ইংরেজ ও নবাবের সাথে কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে মীর কাসিম পরাজিত হয়। ১৭৬৪ সালে বক্সারের প্রান্তরে মীর কাসিম, শাহ আলম ও সুজা-উদ-দৌলার সম্মিলিত বাহিনী পরাজিত হয়। ফলে কোম্পানির আধিপত্য বিস্তারের পথ পরিষ্কার হয়। এ আধিপত্য বিস্তারের থেকে পরে কোম্পানি দেওয়ানি লাভের দিকে এগিয়ে যায়।

৩. কোম্পানির ক্ষমতাকে বৈধতা দান: বক্সারের যুদ্ধে জয়ের পর কোম্পানির অপ্রত্যাশিত ক্ষমতা লাভকে দৃঢ়ভিক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এবং কূটকৌশল এবং বল প্রয়োগ দ্বারা অর্জিত ক্ষমতাকে বৈধতা দেওয়ার জন্য ইংরেজদের সন্ধি-চুক্তির সন্ধান করতে হয়, যা এলাহাবাদে এসে তারা পেয়ে যায়।

৪. ক্লাইভের দ্বিতীয়বারের মতো ভারতে গমন: বক্সারের যুদ্ধে ভারতের সম্মিলিত শক্তির পরাজয় ভারতে রাজনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনে। কোম্পানির অভ্যন্তরীণ ব্যাপারেও দুর্নীতি ও অব্যবস্থা চরম আকার ধারণ করে। এমতাবস্থায় ভারতে কোম্পানি প্রশাসনে শৃঙ্খলা আনয়ন এবং ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত স্থাপনের লক্ষ্যে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ লর্ড ক্লাইভকে দ্বিতীয়বার গভর্নর করে ভারতে প্রেরণ করেন। ঠিকান

এলাহাবাদের সন্ধি: লর্ড ক্লাইভ এলাবাদে দুটি সন্ধি করেন। ক্লাইভ প্রথমে ১৭৬৫ সালের আগস্ট মাসে অযোধ্যার নবাবের সঙ্গে এলাহাবাদের চুক্তি স্বাক্ষর করেন।

এলাহাবাদের প্রথম সন্ধি: এলাহাবাদের প্রথম চুক্তিগুলো হলো:

১. সুজাউদ্দৌলাকে অযোধ্যার নবাব পদে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়;

২. এর বিনিময়ে নবাব কোম্পানিকে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫০ লক্ষ টাকা দিতে স্বীকৃত হন;

৩. নবাব কোম্পানিকে তাঁর রাজ্য থেকে এলাহাবাদ ও কারা জেলা দু’টি প্রদান করেন।

৪. নবাব কোম্পানির সঙ্গে আত্মরক্ষামূলক মিত্রতা স্থাপন করেন;

৫. নবাব কোম্পানিকে তাঁর রাজ্যে বিনাশুল্কে ইংরেজদের বাণিজ্য করার অধিকার প্রদান করেন।

এলাহাবাদের দ্বিতীয় সন্ধি: এরপর লর্ড ক্লাইভের মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সঙ্গে একই বছরে এলাহাবাদের দ্বিতীয় চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তি দ্বারা :

১. মুঘল সম্রাট শাহ আলমকে দিল্লির সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়।

২. কোম্পানি অযোধ্যা নবাবের কাছ থেকে প্রাপ্ত এলাহাবাদ ও কারা জেলা দু’টি শাহ আলমকে প্রদান করেন। এর বিনিময়ে মুঘল সম্রাট এক ফরমান বলে কোম্পানিকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি বা রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা ইংরেজ কোম্পানির হাতে তুলে দেন।

৩. দেওয়ানি লাভের বিনিময়ে ইংরেজরা শাহ আলমকে বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা দিতে অঙ্গীকার করে।

৪. অযোধ্যার নবাবের নিকট হতে পাওয়া কারা ও এলাহাবাদ প্রদেশ কোম্পানি সম্রাটকে ছেড়ে দেবে।

৫. এই চুক্তি দ্বারা সম্রাটকে সাহায্যের আশ্বাস দেওয়া হয়

বাংলায় কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠায় এলাহাবাদ সন্ধির গুরুত্ব : বাংলায় কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠায় এলাহাবাদের দ্বিতীয় সন্ধির গুরুত্ব ছিল অধিক। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

১. বাংলায় কোম্পানির বৈধ অধিকার প্রতিষ্ঠা: শক্তি প্রয়োগের পরিবর্তে কোম্পানি কৌশলে এলাহাবাদের সন্ধির মাধ্যমে মুঘল সম্রাটের ফরমান লাভ করেন। এ চুক্তির ফলে বাংলায় কোম্পানির বৈধ ক্ষমতায় পরিণত হয়।

২. সমগ্র বাংলার রাজস্ব লাভ: এতদিন কোম্পানি মীর জাফর ও মীর কাসিমের সাথে চুক্তি করে বর্ধমান, মেদিনীপুর, চট্টগ্রাম ও ২৪ পরগনার রাজস্ব লাভ করত। এলাহাবাদ চুক্তির পর তারা সমগ্র বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি তথা রাজস্বের আদায়ের ি অধিকার লাভ করার পর বাংলা দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ বাংলার রাজস্ব ও সামরিক ক্ষমতা কোম্পানি নিজ হাতে রাখে। পক্ষান্তরে আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্ব নবাবের উপর ছেড়ে দেয়। অর্থ ও ক্ষমতাহীন নবাব আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্ব লাভ করায় প্রশাসন ও শৃঙ্খলা দ্রুত ভেঙ্গে পড়ে।

৩. দ্বৈত শাসন প্রতিষ্ঠা: এলাহাবাদ সন্ধির মাধ্যমে কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি তথা রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করার পর বাংলায় দ্বৈত শাসন প্রতিষ্ঠা করে।

৪. বাংলায় কোম্পানির পূর্ণ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা : এলাহাবাদের চুক্তির মাধ্যমে কোম্পানি বাংলার দেওয়ানি লাভকরার ফলে বাংলায় কোম্পানির পূর্ণ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়। নবাবকে নামেমাত্র সিংহাসনে রেখে কোম্পানিই সকল ক্ষমতা অধিকার করে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, এলাহাবাদ চুক্তি বাংলার কোম্পানি শাসন প্রতিষ্ঠার সর্বশেষ অংশ ছিল। এ অংশের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করেন রবার্ট ক্লাইভ। এজন্য পিজে মার্শাল ১৭৬৫ সালের দেওয়ানি লাভকে বাংলায় মুঘল যুগ ও ব্রিটিশ যুগের Dividing Live বলে মনে করেন।