অথবা, লাহোর প্রস্তাবের মধ্যে কি স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল? ব্যাখ্যা কর।
উত্তর: ভূমিকা: ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রথমদিকে হিন্দু ও মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধভাবে ব্রিটিশ বিরোধি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পরিচালনা করেন। তখন ভারতবর্ষের সকল মানুষের জাতীয়তাবাদ ছিল এক ও অভিন্ন। কিন্তু একসময় এর মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ঘটলে সকল প্রেক্ষাপট ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হওয়া শুরু করে। হিন্দু ও মুসলমানরা সমন্বিত জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে হিন্দু ও মুসলিম ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের দ্বারা আকৃষ্ট হন। তাছাড়া এতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তিনি যখন বুঝতে পারেন যে, মুসলমানরা পিছনে পড়ছে তখন তিনি মুসলমানদেরকে নিয়ে মুসলিমলীগকে শক্তিশালী করে তোলেন এবং এরই ভিত্তিতে উত্থাপিত হয় লাহোর প্রস্তাব। যা পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পিছনেও অনুপ্রেরণা দান করে।
ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল -উক্তিটি বিশ্লেষণ: ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে গৃহীত লাহোর প্রস্তাব ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কেননা লাহোর প্রস্তাব ছিল মুসলমান জনগণের জাগরণ ও আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। তাছাড়া ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের বীজও নিহিত ছিল। নিম্নে তা বিশ্লেষণ করা হলো-
১. পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি: ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের পূর্ব পর্যন্ত ভারতবর্ষের হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলমানরাও ঐক্যবদ্ধ ভারতের জন্য আন্দোলন করে আসছিল। কিন্তু লাহোর প্রস্তাবে ঐক্যবদ্ধ ভারতের পরিবর্তে মুসলমানরা যে সকল অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ যে সকল অঞ্চলে একাধিক পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়। যার ফলে এটি বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।
২. স্বার্থের দ্বন্দ্বের সূত্রপাত: লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার ফলে হিন্দুও মুসলমানদের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটে। এতদিন হিন্দু ও মুসলমানরা যে ঐক্যবদ্ধ স্বার্থ নিয়ে কাজ করে আসছিল লাহোর প্রস্তাব তা নষ্ট করে দেয়। যার ফলে মুসলমান এবং হিন্দুরা তাদের নিজেদের স্বার্থের প্রতি মনোযোগী হয়।
৩. মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি: ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলমান দুটি জাতি বসবাস করলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মুসলমানরা ছিল উপেক্ষিত। বেশির ভাগ সুযোগ সুবিধা হিন্দুরা গ্রহণ করত। এতে করে, মুসলমানদের মধ্যে ধীরে ধীরে ক্ষোভজমা হতে থাকে। ১৯৪০ সালে মুসলমানদের দাবি সংবলিত লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হলে মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।
৪. নির্বাচনে ব্যবধান বৃদ্ধি: লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হলে নির্বাচনে ব্যবধান বৃদ্ধি পায়। ভারতবর্ষের দুইটি দল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে ন লীগ ৪৮৫টি মুসলিম আসনের মধ্যে ১০৯টি আসন লাভ করে। – কিন্তু লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ ৪৯২টি মুসলিম আসনের মধ্যে ৪২৮ টি আসন লাভ করে।
৫. ভারতবর্ষের বিভক্তি: ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর হিন্দু ও মুসলমানদের সম্পর্কের প্রচণ্ড অবণতি ঘটে। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের পর পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির দাবিতে মুসলমানরা ১৬ আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস পালন করে। এ সময় গোটা ভারতবর্ষব্যাপী শুরু হয় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা। হিন্দু ও মুসলমানদের সম্পর্কের চূড়ান্ত ও চরম অবনতি ঘটলে ভারতবর্ষের সকলেই উপলব্ধি করতে পারেন যে ভারতবর্ষ বিভক্তি করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। এরই ভিত্তিতে ১৯৪৭সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
৬. বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি স্থাপন: ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব শুধু পাকিস্তান রাষ্ট্রেরই জন্ম দেয়নি বরং এই প্রস্তাবের ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিও স্থাপিত হয়। লাহোর প্রস্তাবে শুধুমাত্র একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের কথাই বলেনি বরং এতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানের কথাও বলা হয়। পরবর্তীতে স্বাধীন পাকিস্তানে বাঙালিরাও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানায় ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি করে।
৭. ভাষা আন্দোলন : লাহোর প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে বাঙালিদের মধ্যে জাতীয় ঐক্যবোধ তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয় তা পরবর্তীকালে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যখন বাঙালিদের মাতৃভাষা বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয় তখন বাংলার জনগণ বুকের রক্ত দিয়ে তার প্রতিবাদ জানায়।
৮. ছয় দফা কর্মসূচি: বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ হিসেবে পরিচিত ছয় দফা কর্মসূচী যখন ১৯৬৬ সালে ঘোষণা করা হয় তখন তার মধ্যে লাহোর প্রস্তাবের প্রত্যক্ষ রূপ দেখা যায়। ছয় দফার প্রথম দফাতেই উল্লেখ করা হয় যে, ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার যুক্তরাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে। এবং পূর্ব পাকিস্তানসহ সকল প্রদেশকে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করতে হবে। পরবর্তীকালে ছয় দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ছয় দফা ভিত্তিক আন্দোলন শুরু হয়।
৯. ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান: ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রদানের দাবিকে কেন্দ্র করে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। যদিও আইয়ুব সরকারের স্বৈরাচারিতা আরো অনেক ঘটনা এই গণঅভ্যুত্থানের জন্য দায়ী, তবুও এর পিছনে মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে লাহোর প্রস্তাবে উত্থাপিত প্রদেশসমূহের স্বায়ত্তশাসন ও সার্বভৌমত্বের দাবি।
১০. স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা: প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করতে তথা লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র গঠন করতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী অসম্মতি জানালে বাঙালিরা ক্রমান্বয়ে আন্দোলনমুখর ও স্বাধীনতাকামী হয়ে উঠে। এবং এক সময় পাকিস্তানিদের মোকাবেলা করতে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালিরা তাদের ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদে বলীয়ান হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন শুরু করে এবং দীর্ঘ ৯ মাস এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দেয়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, লাহোর প্রস্তাবের মধ্যেই স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল। কেননা লাহোর প্রস্তাবে উত্থাপিত স্বায়ত্তশাসন ও স্বার্বভৌমত্বের দাবি বাঙালিদের অন্তরে গেথে যায় এবং তৈরি হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদ। আর এই জাতীয়তাবাদেই বাঙালিদেরকে আন্দোলনমূখী করে তুলেছিল। এবং এই লাহোর প্রস্তাবের দাবির ভিত্তিতে বাঙালিদের আন্দোলন এক সময় চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের উৎসাহ দেয়। সৃষ্টি হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র।