অথবা, ওয়ারেন হেস্টিংসের অত্যাচার ও আচরণের বিরুদ্ধে অভিযোগসমূহ সম্পর্কে কী জান?
অথবা, ওয়ারেন হেস্টিংসের অত্যাচার ও আচরনের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো সংক্ষেপে বিবরণ দাও।
উত্তর: ভূমিকা: ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসে ওয়ারেন হেস্টিংসের শাসনকাল একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সংযোজন করেছে। কার্টিয়ারের অবসর গ্রহণের পর ১৭৭২ সালে তিনি বাংলার গভর্নর নিযুক্ত হন এবং রেগুলেটিং অ্যাক্ট আইন পাস হবার পর তিনি বাংলার গভর্নর জেনারেল পদে অধিষ্ঠিত হন। তার জীবদ্দশায় তার শত্রুগণ ছিল ভয়ানক নিষ্ঠুর এবং তার বিরুদ্ধে ছিল অবিরাম সোচ্চার। তারা তার সুনাম ও ব যশের বিরুদ্ধে কুৎসামূলক আক্রমণ পরিচালনা করত। তিনি স্থানীয় রাজাদের উপর অনেক অত্যাচার ও নির্যাতন করেছিলেন।
হেস্টিংসের অত্যাচার ও আচরণের বিরুদ্ধে অভিযোগসমূহ: ওয়ারেন হেস্টিংসের অত্যাচার ও আচরণের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহ নিম্নরূপ:
১. বর্ধমানের রানির প্রতি অবিচার: বর্ধমানের রাজা তিলক চাঁদ মৃত্যুমুখে পতিত হলে তার রানি স্বীয় নাবালক পুত্রের অভিভাবিকা নিযুক্ত হলে কলকাতা কাউন্সিল তার স্থলে ব্রজকিশোরকে নিযুক্ত করেন। যা হোক ১৭৭৪ সালে রানি ওয়ারেন হেস্টিংসের বিরুদ্ধে কাউন্সিলের নিকট এ অভিযোগ পেশ করেন যে, ব্রজকিশোর ইংরেজ রেসিডেন্টের সহযোগিতায় অর্থ আত্মসাৎ করছে। অতঃপর, কাউন্সিল ব্রজকিশোরকে সম্পত্তির হিসাব দাখিলে বাধ্য করে। ঐতিহাসিক এইচ. বেভারিজের মতে, ব্রজকিশোরের এই হিসাব হেস্টিংসকে উৎকোচ প্রদানের কথা উল্লেখ ছিল।
২. রাণি ভবানীর অভিযোগ: ১৭৭০ সালে মন্বন্তরে বাংলার পাবনে করলে এক তৃতীয়াংশ লোক মৃত্যুবরণ করলে এবং ১৭৭৩ সালে ফসল বিনষ্ট হওয়ায় রাণি ভবানী খাজনা দিতে বিলম্ব তাকে ১৭৭৪ সালে জমিদার নিযুক্ত করলে ১৭৭৫ সালে রাণি ভবানী হেস্টিংসের বিরুদ্ধে কলকাতা কাউন্সিলের নিকট অভিযোগ দাখিল করেন।
৩. চৈত সিংহের প্রতি অবিচার: ইতিপূর্বে উল্লিখিত নন্দকুমারের প্রতি অবিচার ছাড়াও হেস্টিংস বেনারসের রাজা চৈত সিংহের নিকট বারংবার নির্ধারিত বাৎসরিক কর ছাড়াও নানা দাবি শুরু করেন। চৈত সিংহ একবার দুই লক্ষ এবং আরেকবার পাঁচ লক্ষ টাকা; এমনকি দুই হাজার অশ্বারোহী সৈন্য কোম্পানির ব্যবহারের জন্য হেস্টিংসকে প্রদান করলেও তিনি চৈত সিংহের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রেরণ করেন। চৈত সিংহ পদচ্যুত হয়ে গোয়ালিয়রে আশ্রয় গ্রহণ করেন। অতঃপর চলিশ লক্ষ টাকা বাৎসরিক কর দানের বিনিময়ে হেস্টিংস বেনারসের জমিদারি মহীপ নারায়ণকে অর্পণ করেন।
৪. ঐতিহাসিকদের মতামত : ওয়ারেন হেস্টিংসের অভিযোগ সম্পর্কে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন মতবাদ পোষণ করেছেন। এদের মধ্যে ঐতিহাসিক ভি.ডি. মহাজন বলেন, “চৈত সিংহের প্রতি ওয়ারেন হেস্টিংসের আচরণকে কঠোর ভাষায় নিন্দা করা হয়েছে, চৈত সিংহের প্রতি তার আচরণ ছিল নিষ্ঠুর, নির্মম, অন্যায়, অত্যাচারী ও পীড়াদায়ক। সত্য ও স্পষ্ট কথায় এটা ছিল তার স্বৈরাচার।”
৫. অযোধ্যার বেগমদের ওপর অত্যাচার: নির্মম হেস্টিংস অযোধ্যার নিরীহ বৃদ্ধা বেগমদের ওপরও অর্থ সংগ্রহের জন্য অত্যাচার করতে দ্বিধাবোধ করেননি। ঐতিহাসিক লয়ালের মতে, “হেস্টিংস কর্তৃক চরম নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে অযোধ্যার বেগমদের নিকট হতে অর্থ সংগ্রহ করা একটি নীচ প্রকৃতির কর্ম ব্যতীত আর কিছু নয়।”
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ঐতিহাসিক পি. ই. রবার্টসের সাথে একমত হয়ে বলতে পারি যে, “সম্ভবত হেস্টিংস ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ ইংরেজ শাসক। কিছুটা নৈতিক দোষ থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন গতিশীল ও উর্বর মস্তিষ্ক, অক্লান্ত শক্তি এবং অটুট মনোবলের অধিকারী। এই সব গুণ তাকে সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদগণ হতেও পৃথক বৈশিষ্ট্য দান করেছে।”