অথবা, ওয়ারেন হেস্টিংসের কৃতিত্ব সম্পর্কে যা জান লিখ।
অথবা, ওয়ারেন হেস্টিংসের কৃতিত্ব সম্পর্কে একটি টীকা লিখ।
অথবা, ওয়ারেন হেস্টিংসের কৃতিত্ব বলতে কী বুঝ?
উত্তর : ভূমিকা: ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসে ওয়ারেন হেস্টিংসের শাসনকাল একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কার্টিয়ারের অবসর গ্রহণের পর ১৭৭২ সালে তিনি বাংলার গভর্নর নিযুক্ত হন এবং রেগুলেটিং অ্যাক্ট আইন পাস হবার পর তিনি বাংলার গভর্নর জেনারেল পদে অধিষ্ঠিত হন। তার জীবদ্দশায় তার শত্রুগণ ছিল ভয়ানক, নিষ্ঠুর এবং তার বিরুদ্ধে ছিল অবিরাম সোচ্চার। তারা তার সুনাম ও যশের বিরুদ্ধে কুৎসামূলক আক্রমণ পরিচালনা করত। তিনি স্থানীয় রাজাদের উপর অনেক অত্যাচার ও নির্যাতন করেছিলেন।
ওয়ারেন হেস্টিংসের কৃতিত্ব : ওয়ারেন হেস্টিংসের কৃতিত্ব নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. সমস্যা সমাধানকারী: জনৈক ঐতিহাসিক বলেন, “ওয়ারেন হেস্টিংসের জীবন বৃত্তান্ত সম্পর্কে সম্ভবত সর্বদাই পরস্পর বিরোধী মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। তিনি যখন বাংলার শাসনভার গ্রহণ করেন তখন ক্লাইভ প্রবর্তিত দ্বৈতশাসনের কুফলে দেশবাসী ছিল জর্জরিত, কোম্পানির ইংরেজ কর্মচারীদের মধ্যে দুর্নীতি সে সময়ে চরমে পৌছেছিল, কোম্পানির কোষাগারও তখন শূন্য। তিনি এসব সমস্যাবলির আশু সমাধানে আত্মত্মনিয়োগ করেন।
২. দক্ষ শাসক: তিনি ছিলেন একজন দক্ষ শাসক। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের প্রকোপে দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থা চরমে পৌঁছেছিল। এরূপ পরিস্থিতিতে শাসনভার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি কোম্পানির শাসনে সংহতি স্থাপন করে দক্ষ প্রশাসকের ভূমিকা রেখেছিলেন।
৩. দক্ষ কূটনৈতিক: তার রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত বিচারব্যবস্থা সম্পর্কীয় ও অন্যান্য সংস্কার অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল কোম্পানির রাজ্যের সংহতি ও নিরাপত্তা বিধান করা।
৪. আর্থিক অনটন দূর: কোম্পানির আর্থিক অনটন দূর করার উদ্দেশ্যে তিনি অবৈধভাবে এবং উৎপীড়নের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করতে যেয়ে বিচারের সম্মুখীন হয়েছিলেন। ভারতবাসীর স্বার্থ ও মর্যাদার দৃষ্টিতে তার অত্যাচারী শাসন নিন্দনীয় হলেও তার শাসন নীতি ও কার্যকলাপ নিঃসন্দেহে ইংরেজ জাতির স্বার্থ বৃদ্ধি করেছিল।
৫. দ্বৈতশাসনের বিলুপ্তি: ওয়ারেন হেস্টিংস শাসনভার স্বহস্তে গ্রহণ করেই ক্লাইভের প্রবর্তিত দ্বৈতশাসনের বিলুপ্তি সাধন করেন। বঙ্গ ও বিহারের নায়েব নাজিম রেজা খান এবং সিতাব রায়কে দেওয়ানের পদ হতে অপসারিত করেন এবং “বোর্ড অব রেভিন্যু” স্থাপন করে রাজস্ব সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড তদারকির ভার এর ওপর অর্পণ করেন।
৬. দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত গঠন: সুষ্ঠু বিচারের জন্য তিনি প্রতি জেলায় একটি করে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত প্রতিষ্ঠা করেন। উক্ত বিচারের আপীলের জন্য হেস্টিংস কলকাতার সদর দেওয়ানি আদালত ও সদর নিজামত আদালত নামক দুটি বিচারালয়ও প্রতিষ্ঠা করেন।
৭. শিক্ষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক: এত প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তিনি শিক্ষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি স্বয়ং বিদ্বান ও বিদ্যোৎসাহী ছিলেন। তারই আনুকূল্যে ১৭৮১ সালে কলকাতা মাদ্রাসা, ১৭৮৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি এবং কাশী সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি বাংলা ও ফার্সি ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। সংস্কৃত সাহিত্যের প্রতিও তার অনুরাগ ছিল। তারই অনুপ্রেরণায় হেলেহেড সাহেব প্রথম বাংলা ব্যাকরণ প্রণয়ন ও প্রকাশ করতে সক্ষম হন।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার গোড়াপত্তন, কোম্পানির শাসনে শৃঙ্খলা আনয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার সাধন- সর্বোপরি কোম্পানির রাজস্বকে আসন্ন পতনের সম্ভাবনা হতে সংরক্ষণ করে হেস্টিংস অনন্য সাধারণ দক্ষতা ও ক্ষমতায় পরিচয় দিয়েছেন। ক্লাইভ ইন্দো-পাক উপমহাদেশের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিংস তার কলেবর বৃদ্ধি করেন এবং সংহতি আনয়ন করেন।