কার্যকারণ নিয়ম সম্পর্কে ইবনে রুশদ কিভাবে দার্শনিকদের যুক্তি মূল্যায়ন করেছেন?

অথবা, কার্যকারণ নিয়ম সম্পর্কে গাজালির মতবাদকে খণ্ডন করে ইবনে রুশদ কিভাবে দার্শনিকদের সমর্থন দেয়ার চেষ্টা করেছেন?

অথবা, কার্যকারণ নিয়ম সম্পর্কে ইবনে রুশদ কিভাবে দার্শনিকদের যুক্তি বিশ্লেষণ করেন?

অথবা, কার্যকারণ নিয়ম সম্পর্কে ইবনে রুশদ কিভাবে দার্শনিকদের যুক্তি ব্যাখ্যা করেছেন?

উত্তর: ভূমিকা: মুসলিম জাহানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক হিসেবে ইবনে রুশদ পরিচিত। ইউরোপীয় চিন্তাধারা রেনেসাঁর সময় পর্যন্ত তার দার্শনিক চিন্তাধারা ও সূত্রগুলো দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিল বলে তাকে অনেকে ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক প্রভাবশালী দার্শনিক বলে গণ্য করেন। তিনি যেসব দার্শনিক বিষয় ব্যাখ্যা করেছেন তার মধ্যে কার্যকারণ অন্যতম। কার্যকারণ ধারণা হচ্ছে এমন একটি ধারণা যেখানে মনে করা হয়, জগতের প্রতিটি ঘটনা তার পূর্ববর্তী অবস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং যে অবস্থাটি উপস্থিত হলে উক্ত ঘটনাটি ঘটতে বাধ্য।

কার্যকারণ বিষয়ক যুক্তি : কার্যকারণ সম্পর্কে প্রায় সকল মুসলিম দার্শনিকগণই বিশ্বাস করতেন। এ ধারণা মতে, সকল ঘটনাই তার পূর্ববর্তী অবস্থা দ্বারা এমন এক আবশ্যিক শৃঙ্খলে বাঁধা, যা কখনো রদবদল হয় না। কোনকিছুই প্রকৃতিতে কারণ ছাড়া সংঘটিত হয় না। মুসিলিম দার্শনিকগণ কার্যকারণ বিষয়ে তাদের মতবাদ ব্যক্ত করেন। নিম্নে দার্শনিকদের যুক্তিসমূহ তুলে ধরা হলো:

১. আবশ্যিক নিয়ম: দার্শনিকদের মতে, আমরা জগতের প্রতিটি কার্যের পিছনেই কোন না কোন কারণ দেখতে পাই। কোনকিছু কারণ ছাড়া ঘটে না। ফলে কার্যকারণ একটি আবশ্যিক নিয়ম।

২. নির্দিষ্ট কার্য: দার্শনিকগণ বলেন, বস্তুসমূহ তাদের গুণগুলো আদি উৎস থেকে পেয়ে থাকে। কোন বস্তু এ গুণগুলো পরিবর্তন করতে পারে না। ফলে কোন বিশেষ অবস্থা কোন নির্দিষ্ট কার্যই সংঘটিত করে থাকে।

৩. অগ্নি দহন করতে বাধা: স্বাভাবিক ধর্ম অনুযায়ী বস্তুসমূহ কাজ করে। যেমন- আগুনের স্বাভাবিক ধর্ম হচ্ছে দহন করা। সুতরাং অগ্নি দহন করতে বাধ্য।

৪. স্বতন্ত্র গুণবিশিষ্ট: দার্শনিকরা মনে করেন যে, প্রত্যেক বস্তুই স্বতন্ত্র গুণবিশিষ্ট। অর্থাৎ এটা যা তাই। ফলে প্রত্যেক বস্তু তার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নির্দিষ্ট ঘটনা ঘটিয়ে থাকে।

দার্শনিকদের বিরুদ্ধে ইমাম গাজালির প্রতিবাদ: ইমাম আল গাজালি কার্যকারণ সম্পর্কে দার্শনিকদের যুক্তিসমূহের তীব্র প্রতিবাদ করেন। নিম্নে গাজালির যুক্তিসমূহ আলোচনা করা হলো:

প্রথমত, গাজালির মতে, অনেক ঘটনার পেছনেই তার আবশ্যিক কারণ বা পূর্ববর্তী অবস্থা আমরা খুঁজে পাই না।

দ্বিতীয়ত, গাজালি বলেন যে, এমন বলা চলে না আগুন দহন কার্য করতে বাধ্য। কারণ আল্লাহই আগুনকে দহন ক্ষমতা দান করেছেন। আগুনের এ ক্ষমতা তিনি ইচ্ছা করলে বিনষ্ট করতে পারেন। যেমনটি ইব্রাহিমের ক্ষেত্রে করেছিলেন।

তৃতীয়ত, আল্লাহ পরম ইচ্ছাকারী সত্তা। বস্তুসমূহের জ্ঞান তিনি পরিবর্তন করতে পারেন।

ইবনে রুশদ কর্তৃক গাজালির মতবাদ খণ্ডন: ইবনে রুশদ তার বিখ্যাত “Tahafut al Tahafut” গ্রন্থে ইমাম আল গাজালির মতবাদ খণ্ডন করে দার্শনিকদের সমর্থন করেন। তিনি কার্যকারণ নিয়মকে একটি প্রকৃত নিয়ম বলে বিশ্বাস করেন। নিম্নে ইবনে রুশদ যেসব যুক্তি উপস্থাপন করেছেন তা আলোচনা করা হলো:

১. চাতুর্থপূর্ণ বিভ্রান্তিকর যুক্তির শামিল: ইবনে রুশদ গাজালির প্রতিবাদ করে বলেন যে, আমরা স্বাভাবিকভাবেই প্রকৃতিতে যে কার্যকারণ নিয়ম লক্ষ্য করি তাকে অস্বীকার করা কোনক্রমেই যথার্থ হতে পারে না। তিনি মনে করেন, কার্যকারণের বিরুদ্ধে অহেতুক যুক্তি উপস্থাপন এক ধরনের চাতুর্যপূর্ণ বিভ্রান্তিকর যুক্তির শামিল।

২. কূটতার্কিক প্রকৃতির লোক : ইবনে রুশদ মনে করেন যে, কার্যকারণ নিয়ম যারা অস্বীকার করেন তাদের অনেকেই হয়তো আন্তরিকভাবে করেন না। এদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে রুশদ বলেন যে, হয় এরা মনের প্রকৃত কথা মুখে প্রকাশ করেন না নতুবা কূটতার্কিক প্রকৃতির লোক।

৩. নিমিত কারণ অস্বীকার: ইবনে রুশদ গাজালির সমালোচনা করে বলেন যে, কার্যকারণ নিয়মকে যারা অস্বীকার করেন না অথবা নিমিত্ত কারণ স্বীকার করেন না, তাদের এটা স্বীকার করারও কোন কারণ নেই যে, প্রত্যেকটি কর্মের পিছনে অন্তত একজন কর্তার হাত রয়েছে।

৪. অযৌক্তিক বলে চিহিত : কার্যকারণ নিয়ম সম্পর্কে ইবনে রুশদ তাদের মতবাদ অযৌক্তিক বলে চিহ্নিত করেন। যারা মনে করেন, জগতের অনেক ঘটনারই কারণ লক্ষ্য করা যায় না। তাৎক্ষণিকভাবে কোন ঘটনার কারণ জানা না গেলেও এটা প্রমাণিত হয় না যে, উক্ত ঘটনার কোন কারণ নেই এবং সাময়িকভাবে এটা দ্বারা আমাদের ঐ কারণ সম্পর্কে অজ্ঞতা প্রকাশিত হতে পারে।

৫. ঘটনা কারণহীন: ইবনে রুশদ দার্শনিকদের যুক্তিসমূহ সমর্থন করে বলেন, দার্শনিকগণ জগতের যেসব ঘটনার অন্তরালে কারণ খুঁজে না পেয়ে ঐ সব ঘটনা কারণহীন বলে মনে করেন। তিনি তাদের সম্পর্কে বলেন যে, তারা স্বপ্রমাণিত (Self evident) এবং অজ্ঞাত এর মধ্যে পার্থক্য অনুধাবন করতে পারেন না। সুতরাং আল গাজালির কার্যকারণ নিয়মের অস্বীকৃতি সম্পর্কিত ব্যাখ্যাও এ দোষের শিকার।

৬. কাণ্ডজ্ঞান পরিপন্থী: দার্শনিকদের সমালোচনা করে গাজালি বলেন, দার্শনিকগণ বিশ্বাস করতেন যে, প্রত্যেক পদার্থই বা বস্তুই নিজের গুণাবলি অনুসারে আবশ্যিকভাবে কাজ করে। ইবনে রুশদ এ বিষয়টি অস্বীকার করেন। তার মতে, দার্শনিকগণ কেবল প্রকৃত আকারের ক্ষেত্রে এমন কথা বলেছেন। সুতরাং গাজালির এ মতের বিরুদ্ধে রুশদ তাকে অত্যন্ত আপত্তিকর, এমনকি কাণ্ডজ্ঞান পরিপন্থী বলে ঘোষণা করেছেন।

মূল্যায়ন: ইবনে রুশদ গাজালির বিরুদ্ধে যেভাবে ঢালাওভাবে সমালোচনা করেছেন তা অনেকাংশে যথার্থ নয়। কেননা তিনি গাজালির মতকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে, গাজালি যেন স্বীকারই করেন যে, জগতের মধ্যে নিয়ম শৃঙ্খলা বিদ্যমান রয়েছে। মূলত গাজালি এটা স্বীকার করেন যে, জগতের নিয়ম শৃঙ্খলা বিদ্যমান রয়েছে। তবে এ নিয়মের কোন গ্যারান্টি নেই তাছাড়া রুশদ গাজালির মতবাদকে কাণ্ডজ্ঞানের বিরোধী বলেছেন। মূলত কথাটির বিপরীত ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কারণ গাজালির মত কাণ্ডজ্ঞান দ্বারা হয় তো বুঝা সম্ভব নয়। বুঝলে এ বিতর্ক হতো না।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে বলা যায় যে, ইবনে রুশদ জ্ঞানবিজ্ঞানের সাধনার ক্ষেত্রে কার্যকারণকে যেভাবে অস্বীকার না করার কথা বলেছেন তা অনেক ক্ষেত্রেই যথার্থ মনে হয়। ইমাম আল গাজালি কার্যকারণ নিয়মকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন নি, বরং তিনি এ নিয়মের ক্ষেত্রে সংশয় প্রকাশ করেছেন মাত্র। গাজালির ধারণা, কার্যকারণ কোন আবশ্যিক নিয়ম নয়। সমকালীন বিজ্ঞানও এটা স্বীকার করে নিয়েছে। সুতরাং কার্যকারণ নিয়ম সম্পর্কে ইবনে রুশদের অভিমত গুরুত্বপূর্ণ হলেও গাজালির মতকে আমরা অবহেলা করতে পারি না।