ক্রিপস প্রস্তাব কেন ব্যর্থ হয়েছিল এবং এ প্রস্তাবের প্রতি ভারতের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের মনোভাব আলোচনা কর।

অথবা, ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব কি ছিল? এটি ব্যর্থ হয়েছিল কেন? বর্ণনা কর।

উত্তর: ভূমিকা: ১৯৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীন সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর বাংলার ক্ষমতা ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে যায়। ধীরে ধীরে সমগ্র ভারত ব্রিটিশ শাসনের অধীনে চলে আসে। ১৮৮৫ সালে হিন্দু বা কংগ্রেস এবং ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠনের কালে হিন্দু-মুসলমান রাজনৈতিকভাবে শক্তি সঞ্চয় করে। কিন্তু কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ধীরে ধীরে একে অপরের প্রতিযোগী হিসেবে আবির্ভূত হয়-যার দরুন ভারতে একটি গোলাযোগপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এভাবে ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ শাসন চলাকালীন সময়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের যোগদান মুসলিম লীগের ভারতবর্ষে স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার দাবি এবং কংগ্রেসের স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের দাবি বেশ জোরদার হয়। এ যৌথ সমস্যা ব্রিটিশ সরকারকে বেশ উদ্বিগ্ন করে তোলে। ফলে এর সমাধান হিসেবে ১৯৪২ সালের ২৩ মার্চ ব্রিটেনের অর্থমন্ত্রী স্যার স্ট্যামফোর্ড ক্রিপসকে ভারতের সমস্যা সম্পর্কে আলোচনার জন্য প্রেরণ করেন। তিনি ৩০ মার্চ জনসমক্ষে বেশ কিছু প্রস্তাব তুলে ধরেন যা ক্রিপস প্রস্তাব নামে খ্যাত। কিন্তু ভারতে প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশ ও মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের অসহযোগীতায় শেষ পর্যন্ত এ প্রস্তাব ব্যর্থ হয়।

ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতা: স্যার স্ট্যাফোর্ডে ক্রিপস কর্তৃক ১৯৪২ সালের ৩১ মার্চ ঘোষিত ক্রিপস প্রস্তাবসহ নানা কারণে ব্যর্থ হয়। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো:

১. ভারতে অনুপযুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ: ক্রিপস প্রস্তাব যে সময়ে ভারতে পদার্পণ করেছিল তখন ভারতে এ প্রস্তাব কার্যকর হওয়ার মতো উপযুক্ত পরিবেশ ছিল না এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ঘোষণা করেছিলেন যে, আটলান্টিক সনদ শুধুমাত্র ইউরোপীয় জাতি ও সাম্রাজ্যের জন্য প্রযোজ্য এ ঘোষণা ভারতীয়দের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। ফলে ভারতীয়দের মনে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি বিশ্বাস, আস্থা অনেকখানি কমে গিয়ে সন্দেহ প্রবেশ করে। তাই এ সময়ে এই প্রস্তাব ব্যর্থ হবে এটাই স্বাভাবিক ছিল।

২. ব্রিটিশ সরকারের স্বার্থপরি মনোভাব: ১৯৪২ সালের ক্রিপস প্রস্তাব ঘোষণার মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার ভারত বাসীকে বেস বানিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে চেয়েছিল। কারণ ব্রিটিশ সরকার ভারতকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়ার পক্ষে কখনই ছিল না। এছাড়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ছিল খুবই ধূর্তবাজ। তাই তার কাছ থেকে ভালো কিছু প্রত্যাশা করাটা ছিল বোকামি। মূলত ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীকে লোভ দেখিয়ে যুদ্ধকালীন সময়ে ভারতবাসীকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল।

৩. মুসলিম লীগের মনোভাব: মুসলিম লীগের মনোভাব ও ক্রিপস মিশন ব্যর্থতার জন্য যথেষ্ঠ দায়ী ছিল বলা যায় নিম্নে সেটি আলোচনা করা হলো:

(ক) ক্রিপস প্রস্তাবে সুস্পষ্টভাবে পাকিস্তান দাবি মেনে নেওয়া হয়নি।

(খ) ১৯৪২ সালের এ প্রস্তাবে মুসলমানদের নিয়ে পৃথক গণপরিষদ গঠনের কথাও এ প্রস্তাবে গৃহীত হয়নি।

(গ) এ প্রস্তাবে বর্ণ ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নে কোনো স্পষ্ট প্রস্তাব ছিল না। তাই মুসলিম লীগ এ প্রস্তাব কার্যকর করার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখেনি বরং বিরোধিতা করেছে যা এ প্রস্তাবের গুরুত্বকে কমিয়ে দিয়েছে।

৪. কংগ্রেসের মনোভাব: ১৯৪২ সালের ৩০ মার্চ প্রস্তাবিত ক্রিপস মিশন প্রস্তাবে ব্যর্থ হওয়ার জন্য কংগ্রেসকে দায়ী করা হয়- নিম্নে সেগুলো আলোচনা করা হলো-

(ক) দেশ রক্ষা বিভাগ ভারতীয়দের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়নি।

(খ) সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারের ভিত্তিতে নির্বাচন আনুষ্ঠানের ব্যবস্থা কংগ্রেসের আশানুরূপ হয়নি।

(গ) দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান সংবিধানে বলবৎ রাখার প্রস্তাবও কংগ্রেসের মনঃপুত হয়নি।

(ঘ) দেশীয় রাজ্যের জনগণকে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের স্বাধীনতা প্রদান করা হয়নি।

(ঙ) কংগ্রেসের প্রাণের দাবি অবিলম্বে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার কথাও প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়নি।

(চ) এ প্রস্তাবে গণপরিষদে দেশীয় রাজন্যবর্গের সদস্য মনোনয়ন ব্যবস্থা কংগ্রেসের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি।

(ছ) এছাড়াও ভাইসরয়কে নিয়মতান্ত্রিক প্রধান হিসেবে বজায় রেখে জাতীয় সরকার গঠন সম্পর্কিত ক্রিপস প্রস্তাব কংগ্রেসকে হতাশ করেছিল।

৫. অন্যান্য পার্টির বিরোধিতা: মুসলিম লীগ ছাড়াও অন্যান্য পার্টি, এ প্রস্তাবকে সাদরে গ্রহণ করেনি বরং প্রত্যাখ্যান করেছে। বিশেষ করে শিখরা ভয় পেয়েছিল যদি তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঞ্জাব প্রদেশটি পাকিস্তানে যোগ দেয় তাহলে তাদের গুরুত্ব হ্রাস পাবে। তাই তারা ক্রিপস প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে যা এ প্রস্তাব ব্যর্থতার অন্যতম একটি কারণ।

ক্রিপস প্রস্তাবের প্রতি ভারতের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভাব বা প্রতিক্রিয়া:

(ক) মুসলিম লীগের মনোভাব ১৯৪২ সালের ক্রিপস মিশন প্রস্তাবে মুসলমানদের নিয়ে পৃথক গণপরিষদ গঠনের কথা ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকায় মুসলিম লীগ প্রথমদিকে এ প্রস্তাবে সন্তুষ্ট থাকলেও প্রস্তাবের প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধি করে এ প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে। এছাড়াও আরো কিছু কারণে তারাও প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে সেগুলো নিম্নরূপ:

১. সুনির্দিষ্ট তারিখের উল্লেখ না থাকা: ক্রিপস প্রস্তাব প্রকাশ করা হলে তা কখন বাস্তবায়ন হবে তার কোনো নির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ করা হয়নি। ফলে মুসলিম লীগ এটিকে গুরুত্বহীন ভেবে প্রত্যাখ্যান করে।

২. অখণ্ড ভারত গঠনের পক্ষে মতামত: ১৯৪২ সালের ক্রিপস প্রস্তাবে অখণ্ড ভারত গঠনের কথা বলা হয়। এছাড়া এ প্রস্তাবকে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্য থেকে ভারতীয় ইউনিয়ন গঠনের যে প্রস্তাব তা মুসলিম লীগের মনঃপুত না হওয়ায় তারা এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে।

৩. ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রস্তাব না থাকায়: ১৯৪২ সালের ক্রিপস প্রস্তাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ বা সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে কোনো প্রস্তাব ছিল না। তবে এ সময় হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক ইস্যুটি ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যার ফলে মুসলমানরা এটি মেনে নিতে পারেনি।

৪. গণপরিষদ গঠন সম্পর্কে বিরোধ: ১৯৪২ সালের ক্রিপস প্রস্তাবে ভারত ইউনিয়ন গঠনের লক্ষ্যে একটি গণপরিষদ গঠনের কথা উল্লেখ করা হয়। কিন্তু মুসলিম লীগের উদ্দেশ্য ছিল শুধুমাত্র মুসলমান সদস্য নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হবে।

(ক) কংগ্রেসের মনোভাব: মুসলিম লীগের মতো ক্রিপস প্রস্তাবের প্রতি কংগ্রেসের মনোভাব ছিল নেতিবাচক। নিম্নে সেগুলো আলোচনা করা হলো:

১. প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ব্রিটিশ সরকারের হাতে থাকা: কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের কাছে একটি দাবি করে বলেন যে, যুদ্ধকালীন সময়ে নিরাপত্তার জন্য ক্ষমতা ভারতীয়দের হাতে ছেড়ে দেওয়া হোক কিন্তু ব্রিটিশ সরকার সেটি না করে প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নিজ হাতে রেখে দেন যা কংগ্রেসের মনঃপুত হয়নি।

২. অখণ্ড ভারত গঠনের পরিপন্থি: ১৯৪২ সালের ক্রিপস প্রস্তাব ছিল অখণ্ড ভারত গঠনের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। কংগ্রেসের সমস্ত আন্দোলন ছিল অখণ্ড ভারতের। কংগ্রেস ভারত বিভক্তিতে কখনই বিশ্বাসী ছিল না। ১৯৪২ সালের ক্রিপস প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, প্রদেশগুলো ইচ্ছা করলে ভারতীয় ইউনিয়নের বাইরে থাকতে পারবে। কংগ্রেস নেতারা এ প্রস্তাবের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, এ প্রস্তাব কার্যকরী হলে একাধিক পাকিস্তান সৃষ্টি হবে। জওহরলাল নেহেরুও এ প্রস্তাবের কঠোর সমালোচনা করেন।

৩. প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি: ১৯৪২ সালের ৩০ মার্চ ক্রিপস প্রস্তাবে প্রতিরক্ষাশীল চক্রকে অধিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তাদের মতে, দেশীয় জনগণ কর্তৃক মনোনীত প্রতিনিধিদের দ্বারা সুষ্ঠুভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করা সহজ হবে। গণপরিষদ কর্তৃক প্রস্তাবিত সে নির্বাচিত প্রতিনিধির স্থলে রাণির মনোনীত প্রতিনিধিদের গণপরিষদে আসন লাভকে কংগ্রেস মেনে নিতে পারে নি।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ কেউই ১৯৪২ সালের ক্রিপস মিশনের প্রস্তাবকে মেনে নিতে পারেনি। ফলে ক্রিপস মিশন ব্যর্থতায় পরিণত হয়। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক জটিলতা এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সংকটময় মুহূর্তের এক যুগসন্ধিক্ষণে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন এবং যুদ্ধে ভারতীয়দের সাহায্য-সহযোগিতা লাভের আশায় তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকার ১৯৪২ সালে ক্রিপস মিশন পরিকল্পনা পেশ করেন, যেখানে ভারতীয়দের জন্য কিছু সুবিধা সৃষ্টি হয়েছিল। তবে এ মিশনের প্রস্তাবে বিভিন্ন প্রদেশকে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র থেকে আলাদা হওয়ার যে অধিকার প্রদানের কথা বলা হয় তা পাকিস্তান সৃষ্টির পক্ষে সংয়ক হয়।