খিলাফত অর্থ কী? খিলাফত আন্দোলনের কারণসমূহ ব্যাখ্যা কর।

অথবা, খিলাফত বলতে কি বুঝ? খিলাফত আন্দোলনের কারণসমূহ আলোচনা কর।

উত্তর: ভূমিকা: খিলাফত আন্দোলন ভারত উপমহাদেশে প্রথম স্বতঃস্ফূর্ত ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন। হিন্দু ও মুসলমানরা একই মঞ্চে এসে এ আন্দোলনের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশ নেয়। যদিও শেষপর্যন্ত এ আন্দোলন সফল হয়নি। কিন্তু এ আন্দোলনের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক সচেতনতা জাগ্রত হয় তা পরবর্তীকালে বহু আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করে। এর গুরুত্ব সম্পর্কে ড. বিপিন চন্দ্র বলেন, “খিলাফত আন্দোলন ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনে এক নতুন স্রোতধারা নিয়ে আসে।”

খিলাফতের অর্থ: খিলাফত ইসলামের এক অনস্বীকার্য প্রতিষ্ঠান। ইসলাম ধর্মের রাজনৈতিক কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকে সদা সজীব রাখা এবং ইসলামের ইতিহাস সৃজনের ক্ষেত্রে খিলাফতের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) এর ওফাতের পরবর্তী ত্রিশ বছর খোলাফায়ে রাশেদীনের শাসনামল হিসেবে চিহ্নিত। রসূলুল্লাহ (স.) ত্যাগী অনুসরণ ও সহচর হিসেবে প্রথম চারজন খলিফা ছিলেন নিঃসন্দেহে সর্বোকৃষ্ট। তাঁরা আল্লাহর নির্দেশিত পথে ইসলামের ভূখণ্ডসহ শাসন করতেন। তুরস্কের খিলাফত ছিল মুসলমানদের শ্রদ্ধায় পাত্র। ঐ খিলাফতের প্রতি আনুগত্য ছিল মুসলমানদের রাজনৈতিক জীবনের এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

খিলাফত আন্দোলনের কারণসমূহ: তৎকালীন রাজনৈতিক ঘটনা সম্ভারকে বিশ্লেষণ করলে খিলাফত আন্দোলনের কারণসমূহকে দুভাগে ভাগ কার যায়। যথা- ক. প্রত্যক্ষ কারণ ও খ. পরোক্ষ বা প্রচ্ছন্ন কারণ।

(ক) প্রত্যক্ষ কারণ খিলাফত আন্দোলনের প্রত্যক্ষ কারণসমূহ নিচে আলোচনা করা হলো:

১. তুরস্ক ও খিলাফতের প্রতি ভারতীয় মুসলমানদের সম্প্রীতি ও শ্রদ্ধা: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের বেশিরভাগ মুসলমান তুরস্কের সুলতানকে ইসলামের রক্ষক ও বিশ্ববাসীদের প্রভু হিসেবে স্বীকৃতি জানায়। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তুরস্ক জার্মানির পক্ষ অবলম্বন করে এক ব্রিটেন জার্মানির বিপক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এই সময় ভারতবর্ষের মুসলমানরা ব্রিটিশ সরকারের উপর নিম্নোক্ত শর্তগুলো চাপিয়ে দেয়। শর্তগুলো নিম্নরূপ:

(ক) যুদ্ধশেষে তুরস্ক পরাজিত হলে তুরস্ক সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা বজায় রাখতে হবে।

(খ) তুরস্কের খিলাফত ব্যবস্থাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে।

(গ) তুরস্কের খলিফার প্রতি কোনোরূপ অমর্যাদা কর ব্যবহার করা যাবে না।

২. ব্রিটিশ সরকারের ভূয়া প্রতিশ্রুতি: ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় মুসলমানদের মানসিক অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেও তাদের দাবির শর্তগুলো মেনে নেয় এবং শর্ত পালনে পূর্ণ আস্বাস প্রদান করে এ বিবৃতিতে বলে যে, তুরস্কের খিলাফত উচ্ছেদ কিংবা তুরস্ক সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা ধ্বংস করার কোনো ইচ্ছা ব্রিটিশ সরকারের নেই। তাঁর মতে ব্রিটেন তুরস্কের অখণ্ডতা বিনষ্ট করার জন্য বা খিলাফত ব্যবস্থা ভেঙে দেয়ার জন্য যুদ্ধ করছে না। কিন্তু এটা ছিল কাজ উদ্ধার প্রদত্ত ভূয়া প্রতিশ্রুতি।

৩. ব্রিটিশ সরকারের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ: ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান হলে এক জামার্নিসহ তুরস্ক পরাজিত হলে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় মুসলমানদের দেয়া পূর্ব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে সক্ষম হয়নি। যুদ্ধশেষে জামার্নি তুরস্কের পরাজয় ঘটলে মিত্রশক্তিবর্গ স্যার্ভসে এক চুক্তি সম্পাদন করে। ব্রিটেনসহ মিত্রশক্তিদের দ্বারা রচিত। স্যার্ভাস চুক্তির শর্তানুসারে-

(ক) তুরস্ক তার অধিকৃত এলাকা হারায়।

(খ) তুরস্কের মূল ভূখণ্ড ছিন্নবিচ্ছিন্ন করা হয়।

(গ) খিলাফত ব্যবস্থা হুমকির সম্মুখীন হয় এবং ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি আঘাত হানে।
ফলে ভারতবর্ষের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় অনুভূতি প্রতি অবমাননা প্রদর্শের কারণে তুরস্কের অখণ্ডতা বজায় রেখে খিলাফত ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার মানসে স্যার্ভস চুক্তির শর্তাবলির প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন পূর্বক প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগে ব্রিটিশ সরকারকে অভিযুক্ত করে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ১৯২০ সালে এক দুর্বার আন্দোলন ঝাঁপিয়ে পড়ে। এটিই খিলাফত আন্দোলন।

(খ) পরোক্ষ কারণ : বঙ্গভঙ্গ দের ফলে মুসলমানদের পুঞ্জীভূত হতাশা ও বিদ্বেষানলকে এবং ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের প্রহসন ব্যবস্থাকে অনেকেই খিলাফত আন্দোলনের পরোক্ষ কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন। খিলাফত আন্দোলনের পরোক্ষ কারণসমূহ নিচে আলোচনা করা হলো:

১. বঙ্গভঙ্গ রদ: ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের ফলে ভারতীয় মুসলমানরা সামজিক সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বেশকিছু সুবিধা অর্জন করেছিল। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রহিত কারর ফলে মুসলমানরা ব্রিটিশ সরকারের প্রতি বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে, যা পরবর্তীতে মুসলমানরা পরোক্ষভাবে খিলাফত আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার ইন্ধন যুগিয়েছিল।

২. ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন: ১৯১৬ সালে লক্ষ্ণৌ চুক্তির ফলশ্রুতিতে ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায় যৌথভাবে স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলে। ব্রিটিশ সরকার এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় জনগণকে পর্যায়ক্রমে স্বায়ত্ত শাসন প্রদান করবে বলে ঘোষণা করে। কিন্তু ১৯১৯ সালের ভারতে শাসন আইনে ভারতীয় জনগণকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়নি। এক্ষেত্রেও ভারতীয় মুসলমানরা ব্রিটিশ সরকারের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয় এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী হিসেবে ব্রিটিশ সরকারকে চিহ্নিত করে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, খিলাফত আন্দোলনের পরোক্ষ কারণ খিলাফত আন্দোলনের যথার্থ কারণ নয়। পরোক্ষ কারণগুলো আন্দোলনের জন্য মুসলমানরা মনে ঘৃণা, বিদ্বেষ ইত্যাদি সৃষ্টি করার জন্য অপরিহার্য উপাদান হিসেবে কাজ করেছিল সত্য, কিন্তু এ কারণগুলো খিলাফত আন্দোলনের বাস্তবমুখী গতিধারা নির্ধারণে ছিল নীরব। তুরস্কের প্রতি স্যার্ভাস চুক্তির হঠকারিতামূলক শর্তগুলো এক মুসলমান ধর্মীয় আবেগাপ্লুত মূলত খিলাফত আন্দোলনের যথার্থ কারণ হিসেবে চিহ্নিত।