খিলাফত আন্দোলনের গুরুত্ব বর্ণনা কর।

অথবা, খিলাফত আন্দোলনের তা্য আলোচনা কর।

উত্তর: ভূমিকা: খিলাফত আন্দোলন ভারত উপমহাদেশের প্রথম স্বতঃস্ফূর্ত ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন। হিন্দু ও মুসলমানরা একই মঞ্চে এসে এ আন্দোলনের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশ নেয়। যদিও শেষপর্যন্ত এ আন্দোলন সফল হয়নি। কিন্তু এ আন্দোলনের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক সচেতনতা জাগ্রত হয় তা পরবর্তীকালে বহু আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করে। এর গুরুত্ব সম্পর্কে ড. বিপিন চন্দ্র বলেন, খিলাফত আন্দোলন ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনে এক নতুন স্রোতধারা নিয়ে আসে।

খিলাফত আন্দোলনের গুরুত্ব: খিলাফত আন্দোলন ব্যর্থ হলেও এ আন্দোলনের গুরুত্ব ছিল সদূরপ্রসারি। নিম্নে এর গুরুত্ব দেওয়া হলো:

১. সাম্রাজ্য বিরোধী আন্দোলনের সূচনা: মুসলমানদের মনে যে সাম্রাজ্যেবাদ বিরোধী মনোভাব গড়ে উঠেছিল এ আন্দোলন ছিল তারই অভিব্যক্তি। এ কারণে বলা হয় খিলাফতকে কেন্দ্র করেই সাম্রাজ্যেবাদ বিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। কে. কে. আজিজ যথার্থ বলেছেন, এ আন্দোলন ব্রিটিশ আনুগত্যের ধারণা বিনষ্ট করেছিল।

২. রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ: এ আন্দোলনের ফলে মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী মুসলমানদের মধ্যে ব্রিটিশ রাজনৈতিক চেতনার সৃষ্টি হয়। খিলাফত আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতের মুসলমানরা মধ্যভারতীয় পর্যায়ে একটি আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করে। এতে তাদের চেতনার বিকাশ ঘটে।

৩. উপমহাদেশে প্রথম গণসংগ্রাম: খিলাফত আন্দোলন ছিল উপমহাদেশের সর্বপ্রথম গণআন্দোলন। খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের সময় ভারতীয় পর্যায়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত ধনী- দরিদ্রদের মধ্যে যে বিপুল আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল তেমনি ব্রিটিশ ব্যাপক আবেগের প্রকাশ্য প্রদান ভারতে আর কখনো দেখা যায় নি। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহও এত ব্যাপকতা লাভ করেনি।

৪. হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের সৃষ্টি: খিলাফত আন্দোলন একটি গোঁড়াপন্থি আন্দোলন হলেও এই আন্দোলন ভারতে হিন্দু ও মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ ব্রিটিশ বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামের ভিত্তিভূমি সৃষ্টি করেছিল। ঐক্য সম্পর্কে গান্ধীর মত ছিল, হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের এমন সুযোগ একশ বছরেও আর আসবে না। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে তাই তিনি মুসলমানদের খিলাফত দাবিকে -সমর্থন করেন।

৫. ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রেরণা লাভ: যে কোনো আন্দোলনের পেছনে জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন, এ শিক্ষা মুসলমানরা অনুভব করে। বৃহত্তর স্বার্থে সংকীর্ণ স্বার্থের জলাঞ্জলি দেয়ার শিক্ষাও মুসলমানরা লাভ করে ঐ শিক্ষা থেকেই পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের এক অভিন্ন অবস্থান থেকে তারা লড়াইয়ের শিক্ষা নেয়।

৬. স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেরণা লাভ: খিলাফতকে কেন্দ্র করে খিলাফত আন্দোলন শুরু হলেও অচিরেই এটি স্বরাজ আন্দোলনে পরিণত হয়। সেজন্যই হিন্দু-মুসলিম জনগণের মধ্যে এর গ্রহণযোগ্যতা ছিল। এ আন্দোলনের শিক্ষা ও প্রেরণা পরবর্তীকালে ভারতবাসীদের স্বাধীনতা আন্দোলনের শিক্ষা ও প্রেরণা পরবর্তীকালে ভারতবাসীকে স্বাধীনতা আন্দোলনের অনুপ্রেরণা জোগায়।

৭. নতুন মুসলিম নেতৃত্বের সৃষ্টি: খিলাফত আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শহর ও গ্রামাঞ্চলে মুসলিম নেতৃবৃন্দের উদ্ভব ঘটে। এ নেতৃত্ব বাঙালি মুসলমানদের একটি সমন্বিত আত্মসচেতন রাজনৈতিক পরিচিতি তুলে ধরার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

৮. মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমির প্রেরণা: গান্ধী কর্তৃক আন্দোলন বন্ধ করে দেয়ার ফলে মুসলমানরা ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ সরকারের বৈষম্য ও শোষণ নীতি, মুসলমানদের প্রতি চরম বৈরি মনোভাবের কারণে কোনো কোনো মুসলিম নেতা পরবর্তী সময়ে মুসলমানরা স্বতন্ত্র আবাসভূমির চিন্তা ভাবনা শুরু করে।

৯. অসহযোগ আন্দোলনের প্রেরণা: খিলাফত আন্দোলন ভারতের অসহযোগ আন্দোলনকে বিশেষভাবে পরিপুষ্ট করেছিল। এ আন্দোলন জাতীয় আন্দোলনে প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি করে।

১০. কংগ্রেসের নীতি পরিবর্তন : খিলাফত আন্দোলন কংগ্রেসের গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন ঘটায়। গান্ধী নতুন নেতৃত্ব নিয়ে এগিয়ে আসেন। তাঁর অসহযোগ আন্দোলন পরবর্তীকালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রেরণা হিসেবে ভূমিকা রাখে। পরবর্তীতে অনেক নেতারা কংগ্রেস ত্যাগ করে। স্বরাজ পার্টি নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনই করেন।

১১. মুসলিম-হিন্দু ঐক্যে ফাটল: এই আন্দোলনের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ঐক্যকে নষ্ট করে। দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দেয়। সাইমন কমিশন রিপোটে বলা হয় ১৯২২- ১৯২৭ সালের মধ্যে ভারতে ১২২ টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটে।

১২. ব্রিটিশ সরকারের ক্ষমতা প্রদানে উদ্যোগ গ্রহণ: খিলাফত আন্দোলনে হিন্দু-মুসলমানদের যৌথ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ব্রিটিশ সরকারকে ভাবিয়ে তোলে। এরপর ভারতীয়দের হাতেও অধিক ক্ষমতা প্রদানের জন্য তারা বেশকিছু উদ্যোগ নেয়।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯২০ সালে খিলাফত আন্দোলন বিভিন্ন কারণে সংগঠিত হয়। খিলাফত আন্দোলন ছিল ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ভারতীয় মুসলমানদের প্রথম প্রত্যক্ষ আন্দোলন। পরবর্তীতে বিভিন্ন কারনে খিলাফত আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এ আন্দোলন ছিল মূলত গণজাগরণ। সুতরাং, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে খিলাফত আন্দোলন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।