অথবা, ব্যর্থতার আন্দোলনের খিলাফত কারণসমূহ উল্লেখপূর্বক আলোচনা কর।
উত্তর: ভূমিকা: ভারতীয় উপমহাদেশে খিলাফত আন্দোলন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। খিলাফত আন্দোলনকে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক নবজাগরণ বলে আখ্যায়িত করা যায়। এ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সমগ্র ভারতবর্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। বিদেশি শাসনের বন্ধন ছিন্ন করে মুসলমানদের নিজস্ব শাসন প্রতিষ্ঠা করাই ছিল খিলাফত আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
খিলাফত আন্দোলন ব্যর্থতায় কারণ: ১৯২০ সালের আলোচনা করা খিলাফত আন্দোলন ১৯২২ সাল পর্যন্ত ব্যাপক আকারে সর্বভারতীয় পর্যায়ে বিস্তৃত হয়। নিম্নে ব্যর্থতায় কারণসমূহ
হলো:
১. খিলাফতের অবাস্তব দাবি: তুরস্ক সাম্রাজ্যের স্বার্থরক্ষা ও খলিফার পুনর্বাসন ছিল একটি অবাস্তব ও সময় অনুপযোগী দাবি। দীর্ঘ ৪০০ বছর ধরে তুরস্ক সাম্রাজ্যের অধীনে থাকলেও এ সময় মক্কা শরীফ তুরস্কের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রে পরিণত হয়। খিলাফতের জন্য ভারতের মুসলমানরা জান-মাল উৎসর্গ করেছিলেন। তাতে তুরস্কের সমর্থন ছিল না। এ কারণে খিলাফত আন্দোলনের ব্যর্থতা খিলাফত প্রশ্নের মধ্যেই লুক্কায়িত ছিল।
২. নেতৃত্বের অভাব : যোগ্য নেতার অভাবে এ আন্দোলন সফল হতে পারেনি। মওলানা মোহাম্মদ আলী, শওকত আলী, আবুল কালাম আজাদ বার বার গ্রেপ্তার হলে অন্য কোনো মুসলিম নেতার সর্বভারতীয় পরিচিতি ছিল না। ১৯২২ সালে সহিংসতার জন্য গান্ধী আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ালে খিলাফত আন্দোলন নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে।
৩. রাজনৈতিক দলের অভাব: ১৯২০ সালে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ খিলাফত আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানালে ও তা ছিল সম্পূর্ণভাবে তাদের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি সাংগঠনিক দিক দিয়ে দুর্বল খিলাফত কমিটি এ আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করলেও তা রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে নিজেকে সংগঠিত করতে ব্যর্থ হয়। ফলে এ আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
৪. সহিংসতা: খিলাফত আন্দোলনের ব্যর্থতায় জন্য উত্তর প্রদেশের চৌরাচৌরা থানায় অগ্নিসংযোগের ঘটনা এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের প্রত্যাহারকে দায়ী করা হয়। একতরফাভাবে গান্ধীর এ সিদ্ধান্তে খিলাফত আন্দোলন ক্রমে দুর্বল এবং পরে স্তিমিত হয়।
৫. মালাবারের হত্যাকাণ্ড: ১৯২১ সালে দক্ষিণ ভারতের মালাবারের দুর্ধর্ষ মুসলমান বিদ্রোহী হয়ে কয়েকজন ইউরোপীয় এবং বহু হিন্দুকে হত্যা করেন। ১৯২২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে উত্তরণ প্রদেশের গোরক্ষপুরের কাছে চৌরাচৌরা থানায় একদল হিংস্র জনতা ২১ জন পুলিশকে জীবন্ত হত্যা করেন। এ ঘটনায় গান্ধীজী ভীষণ মর্মাহত হন এবং অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেন। এর ফলে আন্দোলন থেমে যায়।
৬. ব্রিটিশ সরকারের দমননীতি: খিলাফত অসহযোগ আন্দোলন যখন তুরস্ক চলে যায তখন ব্রিটিশ সরকার দমননীতি চালু করে। খিলাফত আন্দোলনের নেতাদের বন্দি করেন এবং গান্ধীজীক্ষেও বন্দি করেন। ফলে দেখা যায়, নেতৃত্ব শূন্য হয়ে আন্দোলন আর অগ্রসর হতে পারেনি।
৭. হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে অবিশ্বাস: এ আন্দোলন হিন্দু ও মুসলমানদের সকলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়নি। হিন্দুদের বড় অংশ অসহযোগ সম্পর্কে উৎসাহী ছিলেন না। মুসলমানদের অনেকে অসহযোগ মেনে নেয়নি। ফলে হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের জন্য অবিশ্বাসের খিলাফত আন্দোলনকে দুর্বল করে দেয়।
৮. আর্থ- সামাজিক কর্মসূচির অনুপস্থিত: যে-কোনো ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যের বিরোধী আন্দোলন তখনই জোরদারই হয়ে উঠে যখন তার পেছনে ব্যাপক অর্থনৈতিক ও সামজিক ক্ষোভশোষণ ও অসন্তোষ মরিয়া হয়ে তোলে। অথচ সাধারণ মানুষের ক্ষোভ দূর করার কোনো কর্মসূচি খিলাফতদের ছিল না।
৯. সাম্প্রাদায়িক দাঙ্গা: হিন্দু ও মুসলিম জনগণ একসাথে বিরোধী আন্দোলন শুরু করলে খুব শীঘ্রই তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেঁধে যায়। ফলে ১৯২১-১৯২২ সালে মহররম উপলক্ষে ও ১৯২২-১৯২৩ সালে বাংলা ও পাঞ্জাবে ১৯২৩ সালে অমৃতসর, মুলতান ও পাঞ্জাব, মিরাট, আজমীর প্রভৃতি স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেঁধে যায়। এ টনার ফলে আন্দোলনের প্রকৃত উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলে তাই তা ব্যর্থ হয়।
১০. রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আন্তরিকতার অভাব: এ সময় ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন এ খিলাফত প্রশ্নে কংগ্রেস দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। খিলাফত কমিটি সাংঘঠনিক দিক দিয়ে যেমন দুর্বল ছিল তেমনি এর নেতৃত্বের অভাব ছিল প্রবল। কাগজে কলমে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ খিলাফত সমর্থক হলেও বাস্তবে এরা ছিল কম উদ্যোগী। এ কারণে হিন্দু মুসলমানদের বৃহৎ অংশেই এ আন্দোলনে মুক্ত হয়নি।
১১. খিলাফতের বিলুপ্তি: তুরস্কের একটি বিপ্লবী দল মোস্ত ফা কামাল পাশার নেতৃত্ব ক্ষমতা দখল করে। মোস্তফা কামাল পাশা ১৯২৩ সালে তুরস্ক সালতানাত ও খিলাফত ভেঙ্গে দিয়ে ধর্ম নিরক্ষেপ প্রজাতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে। ফলে ভারতে খিলাফত আন্দোলনের যৌক্তিকতা নষ্ট হয়ে যায়। যার প্রেক্ষিতে ১৯২৪ সালে খিলাফত আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, কোনো আন্দোলনই এ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়নি। খিলাফত আন্দোলন থেমে গেলেও ফলাফলের দিক থেকে এটি সম্পূর্ণ ব্যর্থ বলা যায় না। এই আন্দোলন মুসলমানদের জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করে। এই প্রথম মুসলমানরা আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। মুসলমানরা এর পর স্বাধীনতার দাবি তোলে, যা ২৫ বছর পর ১৯৪৭ সালে সফল হয়।