খিলাফত আন্দোলন কী? এ আন্দোলনের প্রেক্ষাপট আলোচনা কর।

অথবা, খিলাফত আন্দোলনের পটভূমি বর্ণনা কর।

অথবা, খিলাফত আন্দোলন বলতে কি বুঝ?

উত্তর: ভূমিকা: ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের শাসনামলে অনেক আন্দোলন সংগ্রাম বিদ্রোহ লক্ষ করা যায়। এর মধ্যে খিলাফত আন্দোলন অন্যতম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তুরস্ক’জার্মানির পক্ষ অবলম্বন করলে ব্রিটিশ তুরস্কের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তুরস্ককে ৫৩ বিখণ্ড করতে চায়। এ সময়ে তুরস্ক ছিল মুসলমানদের বিলাফতের পবিত্র স্থান। ব্রিটিশরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যুদ্ধ শেষে তারা তুরস্কের খিলাফত রক্ষা করবে, কিন্তু না করায় ভারতীয় মুসলমানরা খিলাফতের মর্যাদা রক্ষার্থে একটি আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯২০ সালে, সেটিকে খিলাফত আন্দোলন বলা হয়। খিলাফত আন্দোলন মুসলমানদের দ্বারা পরিচালিত, প্রথম আন্দোলন, তবে এ আন্দোলন বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেনি।

খিলাফত আন্দোলন: খিলাফতকে ইসলাম ধর্মের অন্যতম একটি মর্যাদার বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর ইসলামের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, মহানবী (সা.) এর ওফাতের পর খিলাফতের মর্যাদা ৬৩২-৬৬১ পর্যন্ত বজায় ছিল। এরপর উমাইয়া খিলাফত ৬৬১-৭৫০ পর্যন্ত বজায় ছিল এবং আব্বাসীয় রাজতান্ত্রিক খিলাফতের ৭৫০-১২৫৮ পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। এরপর ইসলাম ধর্মে তুরস্কের খিলাফতকে পবিত্র বলে মনে করা হত। এই খিলাফতকে কেন্দ্র করেই ভারতীয় উপমহাদেশে আন্দোলন শুরু হয়। এই খিলাফতকে রক্ষা করতে মুসলমানরা সর্বদাই প্রস্তুত ছিল। এদিকে ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তুরস্ক জার্মানিকে সমর্থন করে এবং জার্মানি ছিল ব্রিটিশদের শত্রু। ফলে ব্রিটিশরা তুরস্কের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এ সময়ে ধর্মীয় দিক থেকে ভারতীয় মুসলমানরা তুরস্ককে সমর্থন করে এবং রাজনৈতিক দিক থেকে ব্রিটিশদের অনুগত ছিল। ফলে ভারতীয় মুসলমানরা একটি উভয় সংকটে পড়ে যায়। এক পর্যায়ে ভারতীয় মুসলমানরা তুরস্কের খিলাফত রক্ষা সংক্রান্ত একটি দাবি ব্রিটিশ সরকারের নিকট পেশ করেন। তখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ প্রতিশ্রুতি দেন যে, এ যুদ্ধ হলো তুরস্কের বিরুদ্ধে কিন্তু খিলাফতের বিরুদ্ধে নয়। কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তীতে তারা বলে, এটা তাদের একার আওতার বাইরে। তাই ব্রিটিশ সরকারের কিছুই করার নেই। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যে মুসলমানরা হতাশ হয়ে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কারণে ব্রিটিশ সরকারকে চাপ দেন এবং খিলাফত আন্দোলন গড়ে তোলেন। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন মওলানা মুহাম্মদ আলী ভ্রাতৃদ্বয়। মুসলমানদের দ্বারা পরিচালিত খিলাফত রক্ষা উদ্দেশ্য ব্রিটিশ বিরোধী এই আন্দোলনকে খিলাফত আন্দোলন বলা হয়।

খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপট/পটভূমি: মুসলমানদের খিলাফতের প্রতি সবসময় শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে দেখা যায়। তুরস্কের খিলাফতও তার ব্যতিক্রম ছিল না। হযরত মুহাম্মদ (সা) এর ওফাতের পর হযরত আবু বকর (রা) থেকে হযরত আলী (রা) পর্যন্ত অর্থাৎ (৬৩২-৬৬১) সাল পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। এরপর (৬৬১-৭৫০) পর্যন্ত উমাইয়া খিলাফতের শাসন ছিল এবং (৭৫০-১২৫৮) পর্যন্ত ছিল আব্বাসীয় খিলাফত। ইসলাম ধর্মে এই খিলাফতকে সব সময় অনেক গুরুত্ব দেওয়া হত। তবে আব্বাসীয় ফিলাফতের পর এই খিলাফতকে পূর্বের মত মূল্যায়ন না করলেও পরবর্তীতে তুরস্কের খিলাফতকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হত। এমনি এক পর্যায়ে ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তুরস্ক জার্মানির পক্ষ অবলম্বন করলে ব্রিটিশ সরকার তুরস্কের বিরুদ্ধে চলে যায়। মুসলমানদের ব্রিটিশ সরকার প্রতিশ্রুতি দেয় যে, তারা তুরস্কের অখণ্ডতা বজায় রাখবে কিন্তু যুদ্ধ শেষে তারা তাদের প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে যায় ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর তারা তুরস্কের খণ্ড বিখণ্ড করে ফেলে। মুসলমানদের আর একটি দাবি ছিল যুদ্ধের পূর্বে তুরস্কের পবিত্র স্থানসমূহ সরাসরি তুরস্কের খলিফার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কিন্তু যুদ্ধ বিরতির শর্তানুযায়ী তুরস্কের তার নিজস্ব আবাসভূমি থেকে বঞ্চিত করা হয়। ব্রিটেন ও ফ্রান্স তুরস্ক সাম্রাজ্যের এশিয়া অঞ্চলসমূহ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। ফলে মিত্রশক্তি তুরস্কের শাসনভার নিজেদের হস্তগত করে সুলতানকে একজন কয়েদির ন্যায় তাদের হাতের ক্রীড়ানক হিসেবে রেখে দেয়। ভারতীয় মুসলমানরা ব্রিটিশ সরকারের এখন আচরণে হতবাক হয় বরং এই বিশ্বাসঘাতকতার দরুন ক্ষোভে আন্দোলনে ফেটে পড়ে। প্রথমে ভারতীয় বোম্বের মুসলমানরা মজলিশে খিলাফত নামে একটি সংস্থা গঠন করে এবং লক্ষ্ণৌতে সর্বভারতীয় খিলাফত কমিটির একটি অধিবেশন আহবান ও পূর্ণাঙ্গ কমিটি আহবান করে। এ. কে. এম. ফজলুল হকের সভাপতিত্বে কতকগুলো প্রস্তাব গৃহীত হয়। যথা-

(ক) ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করতে হবে।

(খ) মুসলমানদের প্রতি অনুরোধ জানানো হবে যে, তারা যেন ব্রিটিশ সরকারের বিজয় উৎসবে যোগদান না করে।

(গ) সরকার খিলাফতের ব্যাপারে দাবি না মানলে ব্রিটিশ সরকারের সাথে অসহযোগের ডাক দেয়া হবে।

এই অধিবেশনের সিদ্ধান্তের সাথে গান্ধীজি একমত হন। ফলে হিন্দু ও মুসলমান যৌথ সভায় গান্ধীজি খিলাফত আন্দোলকে সহযোগিতা করার ঘোষণা দেন। তিনি আরও বলেন এরকম | আন্দোলন করার সুযোগ আর একশ বছরেও পাওয়া যাবে না। খিলাফত আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন মওলানা মুহাম্মদ আলী, মওলানা আবদুল বারী, মওলানা শওকত প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। ধীরে ধীরে খিলাফত আন্দোলন আরো বেগবান হয়। ১৯১৯ সালে অমৃতসর মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস মিলিত হয়। এই অধিবেশনে সিদ্ধান্ত হয় যে খিলাফতের ব্যাপারে ইউরোপে একটি প্রতিনিধি প্রেরণ করা হবে। ড. আনসারীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল প্রথম ভাইসরয় এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু তিনি তুরস্কের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার জানান। পরবর্তীতে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ মওলানা মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রী লর্ড জর্জের সাথে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীও তাদের কোনো দাবি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিতে ব্যর্থ হয়। ফলে মওলানা মোহাম্মদ আলী ব্রিটিশ শাসনকে ধ্বংসকারী শাসন বলে প্রচারণা চালান এবং আরোও বলেন মুসলমানরা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে তবু আত্মা বিক্রি করবে না।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ব্রিটিশদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কারণে ভারতীয় মুসলমানরা খিলাফত রক্ষার জন্য এ আন্দোলন করতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে ১৯১৯ সালের অধিবেশনের সিদ্ধান্তের সাথে গান্ধীজি একাত্মতা ঘোষণা করেন। এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন মওলানা মুহাম্মদ আলী, মওলানা শওকত আলী প্রমুখ এবং মওলানা আবদুল বারী। আর হিন্দু ও মুসলমান যৌথ উদ্যোগে এ আন্দোলন আরো বেগবান হয়।