গণতন্ত্র সম্পর্কে প্লেটোর ধারণা ব্যাখ্যা কর।

অথবা, গণতন্ত্র সম্পর্কে প্লেটোর মতবাদ আলোচনা কর।

অথবা, গণতন্ত্র সম্পর্কে প্লেটোর ধারণা উল্লেখ কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: প্রাচীন গ্রিক দর্শনের স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় সক্রেটিস, প্লেটো ও এরিস্টটল। জ্ঞানবিজ্ঞান ও চিন্তার জগতে এ তিন নক্ষত্রের অতুলনীয় অবদান চির অম্লান। এদের মধ্যে মহামতি প্লেটো এক অনন্য অধ্যায়, যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছে সর্বকালের জ্ঞানবিজ্ঞান, দর্শন ও রাজনৈতিক চিন্তাধারায়। গণতন্ত্র সম্পর্কে প্লেটোর ধারণা ব্যাখ্যা করতে হলে প্রথমেই আমাদেরকে নজর দিতে হয় প্রাচীন মিক নগরের রাষ্ট্রগুলোর দিকে। প্রাচীন গ্রিক নগরের রাষ্ট্রগুলো আধুনিক রাষ্ট্রের মতো ছিল না। প্রাচীন গ্রিসের ‘Polis’ ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধরনের এবং ‘হেলেনিক’ জগৎ বলতে যা বুঝায় তা ছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কতকগুলো শহরের সমন্বয়। গ্রিসীয় উপত্যকায় অবস্থিত এ শহরগুলো ছিল সমুদ্রসংলগ্ন এবং এদের প্রত্যেকটির শাসনব্যবস্থা ছিল স্বাধীন ও স্বতন্ত্র। কোথাও প্রচলিত ছিল কঠোর অভিজাত তন্ত্র এবং কোথাও উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। কিন্তু এসব নগররাষ্ট্রের মধ্যে যে দুটি ইতিহাসে ভিন্নতর সমাজ ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের জন্য বিশেষভাবে উল্লেখ্য। আর তা হলো এথেন্স ও স্পার্টা। এথেন্স ছিল উদারনৈতিক দেশ, অন্যদিকে স্পার্টা শাসিত হতো অভিজাতদের দ্বারা।

গণতন্ত্র সম্পর্কে প্লেটোর ব্যাখ্যা: প্লেটোর মতে, আদর্শ রাষ্ট্রের আদর্শ বিচ্যুতির তৃতীয় পর্যায়ে যে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয় তাকে বলা যায় গণতন্ত্র (Democracy)। ধনিকতন্ত্রের দারিদ্র্যক্লিষ্ট জনগণ বিত্তশালীদের শোষণ থেকে নিজেদের মুক্ত করে অবাধ স্বাধীনতা ভোগের আশায় একদিন বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং ধনীদেরকে উচ্ছেদ করে নিজের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার জন্য অধীর আগ্রহ থেকে এ সরকারের জন্ম হয়, কিন্তু স্বাধীনতা বেশিদিন তার নির্মলতা বজায় রাখতে পারে না, অচিরেই তা উচ্ছৃঙ্খলতায় পরিণত হয় এবং সারা দেশব্যাপী নৈরাজ্যের দুঃসহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। গণতান্ত্রিক শাসনে ব্যক্তির উদগ্র স্বাধীনতা লিলা সারা দেশকে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও কলহবিবাদে খণ্ডবিখণ্ড করে ফেলে।
বস্তুত ‘The Statesman’ গ্রন্থে প্লেটো সরকারের নবতর শ্রেণিবিভাগ করেছেন। আদর্শ রাষ্ট্রের বিচ্যুতির ফলে ক্রমানুসারে রাষ্ট্রগুলোকে উচ্চাভিলাষতন্ত্র (Timocracy), কতিপয়তন্ত্র (Oligarchy), গণতন্ত্র (Democracy) স্বৈরতন্ত্র (Tyranny) এভাবে ভাগ করেছেন। উক্ত গ্রন্থে তিনি এ শ্রেণিবিভাগকে সম্প্রসারণ করেছেন। আইন মান্যকারী রাষ্ট্রসমূহে আইনের মাধ্যমে জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। শাসনকর্তাদের সংখ্যানুসারে রাষ্ট্রের প্রথম শ্রেণিবিভাগ হচ্ছে যথাক্রমে একজনের শাসন রাজতন্ত্র, কয়েকজনের শাসন কতিপয়তন্ত্র এবং বহুজনের শাসন উত্তম গণতন্ত্র। অন্যদিকে, আইনহীন রাষ্ট্রের শ্রেণিবিভাগ দাঁড়ায় যথাক্রমে একজনের শাসন স্বৈরতন্ত্র, কতিপয়ের শাসন ধনিকতন্ত্র এবং বহুজনের শাসন চরম গণতন্ত্র।

সামগ্রিকভাবে প্লেটোর চিন্তাধারা ও দর্শনের পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তাঁর সমসাময়িক কালের অপরাপর দার্শনিকদের চিন্তার প্রভাব পড়েছে তাঁর উপর। তাঁর দর্শনে অধ্যাত্মবাদীদের ধারণা প্রকৃতপক্ষে দার্শনিক পিথাগোরাসের কাছ থেকে এসেছে। পার্মানাইডসের দর্শন থেকে তিনি শিক্ষা লাভ করেন যে, পরমসত্তা হলো চিরায়ত। অন্যদিকে, হিরাক্লিটাস ছিলেন গণতন্ত্রবিরোধী। প্লেটো নিজে ছিলেন ভাববাদী (Idealist) দার্শনিক।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, সক্রেটিসের মৃত্যু ঘটনা এবং তৎকালে এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে বিরামহীন যুদ্ধাবস্থা তাঁকে আদর্শ রাষ্ট্রের কথা, ন্যায়নীতির কথা ভাবায় এবং গণতন্ত্রবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলে। প্লেটো মনে করতেন যে, প্রত্যয়ের বা ভাবের যে জগৎ আছে তা ত্রুটিহীন। দৃশ্যমান জগৎ ছিল তাঁর কাছে তুচ্ছ ও অবহেলার বস্তু।