ছয়দফা কর্মসূচিকে কেন বাঙালির ম্যাগনাকার্টা বলা হয়?

অথবা, ১৯৬৬ সালের ছয়দফা ছিল বাঙালির ‘মুক্তির সনদ’ ব্যাখ্যা কর।

অথবা, ছয়দফা ছিল বাঙালি জাতির ‘ম্যাগনাকার্টা’ সংক্ষেপে আলোচনা কর।

উত্তরা। ভূমিকা: Magna Carta বা স্বাধীনতার সনদ প্রত্যয়টি বহুল ব্যবহৃত ও জনসমাদৃত। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক উত্থাপিত ঐতিহাসিক ছয়দফা দাবি বাঙালি জাতির Magna Carta বা স্বাধীনতার সনদ। ইংল্যান্ডের ইতিহাসে ১২১৫ সালে ব্যাপক আন্দোলনের পর ইংল্যান্ডের জনগণ রাজা জনের কাছ থেকে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা সংক্রান্ত যে সনদ লাভ করে তা Magna Carta নামে পরিচিত। স্বাধীন বাংলার ইতিহাসে ঐতিহাসিক ছয়দফা দাবি ছিল ইংল্যান্ডের Magna Carta এর মতোই মুক্তি বা স্বাধীনতার সনদ। পাকিস্তানের শাসন ও শোষণের যাঁতাকলে পড়ে সমগ্র বাঙালি জাতি যখন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দিশেহারা তখন। ছয়দফা আনে বাঙালি জাতির মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্যের এক অমিয় ধারা। এরই সুধা পান করে সমগ্র বাঙালি সত্তা স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয়ে বলীয়ান হয়ে উঠে এবং ছয়দফা ভিত্তিক স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে। ছয়দফা ছিল মূলত পূর্ব পাকিস্তানবাসী বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবি। পাকিস্তানি শাসন, শোষণ, অত্যাচার ও বঞ্চনার হাত থেকে পূর্ব পাকিস্তানবাসী বাঙালিদেরকে মুক্ত করার দাবি। সুতরাং রাজতান্ত্রিক ব্রিটেনের শোষণ অত্যাচার মুক্ত হওয়ার আন্দোলনের ফল যেমন ছিল Magna carta তেমনি পাকিস্তানিদের শোষণ অত্যাচার থেকে মুক্ত হওয়ার ছয়দফা ভিত্তিক আন্দোলনের ফল ছিল বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা।
ম্যাগনাকার্টা: Magna Carta এর বাংলা অর্থ ‘স্বাধীনতা সনদ’ বা ‘মুক্তি সনদ’। ব্যাপক আন্দোলনের ফলে ইংল্যান্ডের জনগণ ১২১৫ সালে রাজা জন এর কাছ থেকে রাজনৈতিক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা সংক্রান্ত এই সনদ আদায় করেছিল। এই সনদের বিষয় ছিল নিম্নরূপ:

১. রাজা প্রজাদের নিকট থেকে নিজের জন্য কোনো অর্থ আদায় করতে পারবেন না।

২. পার্লামেন্টের মত না নিয়ে রাজা প্রথম পুত্রকে যুবরাজ পদে অধিষ্ঠিত করতে পারবেন না।

৩. বিচার ছাড়া কাউকে কারারুদ্ধ করা, শাস্তি প্রদান করা বা আইনের আশ্রায়চ্যুত করা চলবে না।

৪. বিচার বিলম্বিত করা বা এ অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা চলবে না।

৫. স্থায়ী দেওয়ানি আদালত প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

ছয়দফা দাবি: ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের উপর পশ্চিম পাকিস্তান ভিত্তিক শাসক শোষকগোষ্ঠী চাপিয়ে দিয়েছিল ঔপনিবেশিক কায়দায় শাসন, শোষণ ও নিপীড়ন। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য এবং শোষণ ও নিপীড়নের প্রেক্ষিতে এবং ১৯৬৫ সালে সংঘটিত পাক-ভারত যুদ্ধের সময় প্রতিরক্ষাহীন পূর্ব পাকিস্তানের চরম অসহায় অবস্থার পটভূমিতে ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের জন্য ছয়দফা আর্থ-প্রশাসনিক কাঠামো সম্বলিত প্রস্তাব ঘোষণা করা হয়। এই ছয়দফার ভিত্তিতেই ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং এর ফলশ্রুতিতেই পর্যায়ক্রমে রাজনৈতিক অচলাবস্থা, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের উত্তব ঘটে। ঐতিহাসিক ছয়দফা ছিল নিম্নরূপ:

১. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র। প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত পার্লামেন্ট হবে ক্ষমতার মূল ভিত্তি।

২. পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা ছাড়া অন্যান্য বিষয় থাকবে প্রদেশের হাতে।

৩. দু অঞ্চলে সহজ বিনিময়যোগ্য দুটি মুদ্রা চালু থাকবে অথবা একই মুদ্রা চালু থাকবে, তবে এক্ষেত্রে মুদ্রা পাচার রোধের ব্যবস্থা থাকবে।

৪. সকল প্রকার কর ট্যাক্স, খাজনাদি নির্ধারণ ও সংগ্রহ করার ক্ষমতা থাকবে প্রদেশের হাতে। সেক্ষেত্রে ব্যয় নির্বাহের জন্য কেন্দ্র একটি অংশ পাবে।

৫. অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা থাকবে স্ব স্ব প্রদেশের হাতে। তবে ব্যয় নির্বাহের জন্য কেন্দ্র একটি অংশ পাবে। এছাড়া প্রত্যেক প্রদেশের বিদেশে বাণিজ্য মিশনে প্রেরণ ও আমদানি রপ্তানি সংক্রান্ত চুক্তি করার অধিকার থাকবে।

৬. পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আলাদা মিলিশিয়া ও প্যারামিলিটারিসহ স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকবে।
ছয়দফা ম্যাগনাকার্টা বা ‘মুক্তির সনদ’: শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক উত্থাপিত ছয়দফা ছিল পাকিস্তানিদের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালির মুক্তির সনদ। ছয়দফার আলোকে তা মুক্তির সনদ ছিল কিনা তা বিচার করা হলো:

১. রাজনৈতিক অধিকার লাভ ছ্যাদফার অন্যতম দাবি ছিল প্রাদেশিক রাজনৈতিক অধিকার লাভ। প্রদেশের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে এ অঞ্চলে পাকিস্তানি শাসকেরা সরাসরি শোষণ, দমন পিড়নের অধিকার হারাতো। ফলে রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের জন্য বাংলার মানুষ আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে যার ফল ছিল মহান স্বাধীনতা।

২. জাতীয়তাবাদের বিকাশ : ছয়দফা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সংগ্রামী শক্তি যোগায়। এ আন্দোলনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পূর্ণ বিকাশ ঘটে। ছয়দফা কর্মসূচি বাঙালিদের কাছে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে ‘মুক্তির সনদ’ হিসেবে দেখা দেয়। ইংল্যান্ডের গণতন্ত্র বিকাশে ম্যাগনাকার্টা যে ভূমিকা পালন করেছিল, ছয়দফা দাবিও বাঙালিদের স্বাধিকার অর্জনের ইতিহাসে সে ভূমিকা পালন করেছিল।

৩. অর্থনৈতিক অধিকার লাভ: ম্যাগনা কার্টার মাধ্যমে রাজা জনের কাছ থেকে ইংল্যান্ডবাসীরা অর্থনৈতিক শোষণের হাত থেকে মুক্ত হয়েছিল। ১৯৬৬ সালে উত্থাপিত হয়দফায় বাঙালিদের অর্থনৈতিক মুক্তির দাবি তুলে ধরা হয়। বাঙালিরা এই অর্থনৈতিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার স্বাধীনতা আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়ে বাংলাকে স্বাধীন করতে সক্ষম হয়।

৪. স্বেচ্ছাচারিতা থেকে মুক্তি: ছয়দফার মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বাংলায় পাকিস্তানিদের স্বৈরতন্ত্রের বিরোধিতা করা হয়। ইংল্যান্ডের ম্যাগনা কার্টায় রাজার স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধের বিধান ছিল। মুক্তি পাগল বাঙালিরা পাকিস্তানিদের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে বাংলাকে স্বাধীন করে। এখানেও দেখা যায় ছয়দফা ম্যাগনা কার্টার মতোই কাজ করেছিল।

৫. শোষণের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ: ছয়দফা ভিত্তিক দাবিগুলো ছিল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক দীর্ঘকাল ধরে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণের বিরুদ্ধে প্রথম বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। প্রস্তাবের প্রণেতা শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই ছয়দফাকে ‘বাংলার কৃষক, মজুর, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত তথা আপামর জনসাধারণের মুক্তির সনদ এবং বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠার নিশ্চিত পদক্ষেপ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, ইংল্যান্ডের ইতিহাসে ব্রিটিশদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিকসহ সার্বিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় ‘ম্যাগনা কার্টা’ একটি মাইলফলক হয়ে আছে। আবার বাংলার মানুষের পাকিস্তানি শাসকদের শোষণমুক্তি বা চূড়ান্ত মহান স্বাধীনতা অর্জনে ছয়দফা ও মাইলফলক হয়ে আছে। তাই ঐতিহাসিক ছয়দফাকে বাঙালি জাতির ম্যাগনাকার্টা বা মুক্তির সনদ বলা হয়ে থাকে।