উত্তর: ভূমিকা: বহুপূর্বকাল থেকেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের একটি নিত্য সমস্যা। এরই একটি উদারহরণ ছিল ১৭৬৯-৭০ সালের দুর্ভিক্ষ, যা ‘ছিয়াত্তরের মন্তন্তর’ নামেই অধিক পরিচিত। তবে এ দুর্ভিক্ষ অন্য সব দুর্যোগগুলো অপেক্ষা ভিন্নধর্মী ছিল। কারণ এ দুর্ভিক্ষের পিছনে প্রাকৃতিক কারণ অপেক্ষা রাজনৈতিক কারণই বেশি দায়ী ছিল। ১৭৬৫-৭২ সময়কালের দ্বৈতশাসনের সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া ছিল এ ১৭৬৯-৭০ সালের দুর্ভিক্ষ।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর: দ্বৈতশাসনের কুফল এবং কোম্পানির কুচক্রী ও স্বার্থন্বেষী আমলাদের উৎপীড়নের ফলে বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। এই শাসনীতির মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করা হলে কৃষকেরা হয় তাদের পেশার পরিবর্তন করে, না হয় অন্যত্র পালিয়ে যায়। এই অবস্থায় ১৭৬৯-৭০ সালে অনাবৃষ্টি ও খরার দরুণ শস্য মারাত্মকভাবে নষ্ট হলে বাংলার অর্থনৈতিক জীবনে এক বিপর্যয় নেমে আসে এবং ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, যা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত। বাংলা ১১৭৬ সালে এই দুর্ভিক্ষ হয় বলে এই দুর্ভিক্ষের নাম ছিয়াত্তরের মন্বন্তর।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কারণ: নিম্নে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কারণ আলোচনা করা হলো:
১. প্রাকৃতিক কারণ : এটি ছিল দুর্ভিক্ষের একটি মৌলিক কারণ। বাংলার অর্থনীতি সবসময়ই কৃষিনির্ভর। অন্যদিকে কৃষি নির্ভর করে প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর, তাই অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টির কারণে কৃষিক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। দুর্ভিক্ষের পূর্ববর্তী বছরগুলোতে বাংলায় অনাবৃষ্টি চলছিল। ফলে ফসলে উৎপাদন বিপজ্জনকভাবে কমে গিয়েছিল। আর সরকার এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করে নি। ফলশ্রুতিতে দুর্ভিক্ষের আগমণ ত্বরান্বিত হয়েছিল।
২. নবাবের ক্ষমতাশূন্যতা: দ্বৈতশাসনের ফলে নবাবের দায়িত্ব থাকলেও তা কার্যকরের কোনো ক্ষমতা ছিল না। অর্থের জন্য নবাব সম্পূর্ণ কোম্পানির উপর নির্ভরশীল ছিলন। তাই দুর্ভিক্ষপূর্ব পরিস্থিতিতে নবাব এর প্রতিকারে কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে পারেন নি। যার ফলে দুর্ভিক্ষ মারাত্মক আকার ধারণ করে। কোম্পানির কর্মচারীদের দুর্নীতি ও অত্যাচার
৩. কোম্পানির সরকার ছিল মূলত একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান: এর মূল লক্ষ্য ছিল অধিক মুনাফা অর্জন। এ উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে তারা সর্বত্রই অন্যায় বাণিজ্য, অবিচার-অত্যাচার শুরু করে। ফলে বাংলার শিল্প-বাণিজ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে দুর্ভিক্ষ ত্বরান্বিত হয়।
৪. দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি: চালের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে অন্যান্য জিনিসেরও মূদ্র বৃদ্ধি পায়। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি গরিবের ক্রয়সীমার বাইরে চলে যায়। দ্রব্যমূল্যের এ ঊর্ধ্বগতি ছিল দুর্ভিক্ষের একটি অন্যতম কারণ।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ফলাফল : নিম্নে ছিয়াত্তরের মন্বন্ত রের ফলাফল আলোচনা করা হলো:
১. পতিত জমির পরিমাণ বৃদ্ধি: দুর্ভিক্ষের কারণে কৃষি কর্মক্ষম জনসংখ্যা হ্রাস পায়। ফলে বিস্তীর্ণ কৃষিজমি অনাবাদি থাকে এবং তা ক্রমে জঙ্গলে পরিণত হয়। কৃষি শ্রমশক্তি কৃষি জমির তুলনায় অনেক কমে যাওয়ায় জমির মূল্য পূর্বাপেক্ষা অনেক কমে যায়।
২. জমিদারেদের লোকসান : দুর্ভিক্ষের ফলে কৃষি শ্রমশক্তি কমে যাওয়ায় অনেক জমি অনাবাদি হযে পড়ে থাকে। ফলে জমিদাররা এসব জমির খাজনা থেকে বঞ্চিত হয়। কিন্তু জমিদারের ক্ষতি অনুপাতে সরকার রাজস্ব কমায় নি। ফলে রাজস্ব শোধ করতে জমিদারদের ঋণ করতে হয়। এক্ষেত্রে বড় বড় জমিদাররা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
৩. তাঁত ও রেশম শিল্পের ক্ষতি: দুর্ভিক্ষের ফলে রেশম ও তাঁত শিল্পে জড়িত শ্রমিকদের মৃত্যুর হার ছিল সবচেয়ে বেশি। উভয় শিল্পই শ্রমিকের অভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জরিপের দেখা যায়, রেশম শিল্পের মতো তাঁত শিল্পেও উৎপাদন পূর্বাপেক্ষা অর্ধেক কমে যায়।
৪. সামাজিক অনুশাসনে ভাঙন: এ দুর্ভিক্ষের একটি ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া ছিল সামাজিক অবক্ষয়। খাদ্যের অন্বেষণে ভবঘুরে যুবকরা সব আইন নিজ হাতে তুলে নিয়ে অরাজকতা সৃষ্টি করে। ফলে সর্বত্রই চলতে থাকে চুরি-ডাকাতি, খুন, রাহাজানি। সরকার এ অরাজকতা নিয়ন্ত্রণ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, রবার্ট ক্লাইভের দ্বৈতশাসনই ছিল ১৭৬৯-৭০ এর দুর্ভিক্ষের মূল কারণ। মূলত ইংরেজ কর্মচারীদের সীমাহীন দুর্নীতি ও অত্যাচারই এ দুর্ভিক্ষকে টেনে এনেছিল। যার ফলে প্রাণ দিতে হয় এদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোককে। আর এ দুর্ভিক্ষের সবচেয়ে বড় প্রতিক্রিয়া হচ্ছে দ্বৈতশাসনের অবসান এবং কোম্পানির নিজ হাতে দেওয়ানি শাসন গ্রহণ।