অথবা, ইবনে রুশদের জগতের অনাদিত্ব সম্পর্কীয় মতবাদ আলোচনা কর।
অথবা, জগতের অনাদিত্ব সম্পর্কে ইবনে রুশদ কী ধারণা পোষণ করেন? ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।
অথবা, জগতের অনাদিত্ব সম্পর্কে ইবনে রুশদ কিরূপ মতবাদ দেন বিস্তারিত ধারণা দাও।
অথবা, ইবনে রুশদের জগতের অনাদিত্ব সম্পর্কীয় মতবাদ বিশ্লেষণ কর।
অথবা, জগতের অনাদিত্ব সম্পর্কে ইবনে রুশদ যে মতবাদ দেন বিস্তারিত লেখ।
উত্তরঃ ভূমিকা: পাশ্চাত্যের মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে ইবনে রুশদ ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। তার পুরো নাম আবুল ওয়ালিদ মোহাম্মদ ইবনে আহাম্মদ ইবনে রুশদ। তিনি একজন শ্রেষ্ঠ আইনজীবী, চিকিৎসাবিদ ও দার্শনিক ছিলেন। ইবনে রুশদ স্বচ্ছ চিন্তার এক অপূর্ব ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। তিনি যেসব দার্শনিক বিষয় ব্যাখ্যা করেছেন তার মধ্যে জগৎ সম্পর্কে আলোচনা অন্যতম। জগৎ যে আল্লাহ কর্তৃক সৃষ্ট তা রুশদ অস্বীকার করেন না, বরং বিষয়টিকে পরিষ্কারভাবে বুঝার জন্য তিনি এর বিচারমূলক ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেন।
জগতের অনাদিত্ব: মুসলিম দার্শনিক ইবনে রুশদ তাঁর ‘তাহাফুত-আল তাহাফুত’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থের প্রথমেই জগতের অনাদিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, জগৎ যে আল্লাহর দ্বারা সৃষ্ট তা সম্পূর্ণ নিশ্চিত। ইবনে রুশদ জগতের অনাদিত্ব সম্পর্কে ইমাম গাজালির সমালোচনা করে দার্শনিকদের মতের সমর্থন করেন। নিম্নে জগতের অনাদিত্ব সম্পর্কে তার মতবাদ তুলে ধরা হলো:
১. জগৎ আল্লাহ কর্তৃক সৃষ্ট : জগতের উৎপত্তি সম্পর্কিত আলোচনায় ইবনে রুশদ স্বীকার করেন যে, জগৎ আল্লাহ কর্তৃর্ক সৃষ্ট। তবে ধর্মতাত্ত্বিকদের মতো তিনি এটা বিশ্বাস করেন না যে, জগৎ আল্লাহ কর্তৃক শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়েছে। তিনি তার মতকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য জগতের সৃষ্টি বিষয়ক মতবাদ পর্যালোচনা করেন। জগৎ আল্লাহর সভা থেকে অনিবার্যভাবে নির্গত হয়েছে। আল্লাহ যেহেতু অনাদি সেহেতু তার সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে জগতও অনাদি হবে।
২. প্রচলিত মতবাদের বিরোধিতা: ইবনে রুশদ ধর্মতত্ত্ববিদদের প্রচলিত মতবাদের বিরোধিতা করেন। তিনি প্রথমে এটা দেখান যে, সাধারণত ধর্মতাত্ত্বিকেরা বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ সর্বশক্তিমান এবং তাঁর ইচ্ছায় কোন এক সময়ে শূন্য থেকে জগৎ সৃষ্টি করেন। এ মতের বিরোধিতা করে আরেকটি মত মনে করে যে, বস্তুতে পূর্ব থেকেই যা কিছু সুপ্ত কামছে তাকে বাস্তবায়িত করাই সৃষ্টি। অপর একটি মত মনে করে যে, শূন্য থেকে কেবল শূন্যই সৃষ্টি হতে পারে এবং পূর্বে অস্তি ত্বশীল কোন বস্তুর অবলম্বন ছাড়া দ্রতার পক্ষেও কোনকিছুই সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।
৩ বিশ্বজগতের অনাদিত্বে বিশ্বাস: ইবনে রুশদ এরিস্টটলের মতো জগতের অনাদিত্বে বিশ্বাস করেন। এরিস্টটলের মতে, স্রষ্টা। শূন্য থেকে কোনকিছু সৃষ্টি করেন না, বরং উপাদান ও আকারের মধ্যে সংযোগ ঘটানোর মাধ্যমে বস্তু উৎপন্ন করেন। স্রষ্টা বস্তুর মধ্যে আকার ধারণের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেন এবং সৃষ্টি এ সম্ভাবনার বিকাশ বা প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। সুটা বস্তুর আকার ও উপাদানকে একত্রিত করেন এবং সম্ভাব্যতাকে বাস্তবতায় পরিণত করেন। অর্থাৎ স্রষ্টা বিশ্বজগতের অন্তর্ভুক্ত সব উপকরণকে সমন্বিত ও সংযুক্ত করেন। এর ফলে বস্তুর উদ্ভব ঘটে। আল্লাহ উপাদান ও আকারের মধ্যে সংযোগ ঘটানোর মাধ্যমে বস্তু উৎপন্ন করেন। সে হিসেবে আল্লাহকে এর কারণ ও স্রষ্টা হিসেবে অভিহিত করা হয়।
৪. অনাদিত্বের কারণ নেই: ইবনে রুশদ বিশ্বজগতের অনাদিত্বে বিশ্বাস করলেও তিনি মনে করেন যে, ‘অনাদি’ শব্দটি আল্লাহ ও বিশ্বজগতের ক্ষেত্রে একই অর্থে প্রযোজ্য হতে পারে না। তিনি বলেন যে, অনাদিত্ব দু রকমের। যথা: সকারণ অনাদিত্ব ও কারণবিহীন অনাদিত্ব। বিশ্বজগতকে অনাদি বলা হয় এ অর্থে যে, অনাদিকাল থেকে বিশ্বজগতের উপর একটি সক্রিয় ও গতিশীল কর্তা কর্মতৎপর রয়েছেন। পক্ষান্তরে, আল্লাহ স্বয়ং অনাদি তবে তার এ অনাদিত্বের পিছনে কোন কারণ নেই। এক অনাদি গতির অধীনে কাল হলো একটা অনাদি অবিরাম চলমানতা, যা নিরন্তর ও এক। কেননা সত্যিকারের এক হচ্ছে নিরস্তর। এটা সুস্পষ্ট যে, গতি ও কাল উভয়ই অনাদি। এ ধারণার বশবর্তী হয়ে ইবনে রুশদ বিশ্বজগতের অনাদিত্বের কথা বলেন।
৫. সম্ভাব্য অস্তিত্ব আবশ্যিক অস্তিত্বকে নির্দেশ করে : দার্শনিকদের মতে, জগতের অস্তিত্ব এর সৃষ্টির পূর্বে সম্ভব ছিল। এর অস্তিত্বে আসা সর্বদাই সম্ভব ছিল তা কোন কালেই অসম্ভব ছিল না। ইমাম গাজালি এ মতের বিরোধিতায় বলেন, দার্শনিকরা ‘সম্ভাবনাময় অস্তিত্ব’ এবং ‘বাস্তব অস্তিত্বের’ মধ্যে পার্থক্য করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তার মতে, জগতের অস্তিত্ব সম্ভাবনাময় বলতে বড়জোর এটা বুঝাতে পারে যে, জগতের অস্তিত্বে আসতে পারে বা আসবে। কিন্তু তা থেকে একথা অনুমিত হয় না যে, কখন এবং কিভাবে তা আসবে বা তা চিরকাল ধরে ছিল কি না। ইবনে রুশদ গাজালির এ মতবাদ প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, সম্ভাব্য অস্তিত্ব আবশ্যিক অস্তিত্বকে নির্দেশ করে। যা অস্তিত্বে আসার পূর্বেই সম্ভব ছিল তা চিরন্তন বলায় বাধা থাকতে পারে না।
মুল্যায়ন: ইবনে রুশদ মুসলিম চিন্তাজগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক হিসেবে সুপরিচিত। তিনি স্বাধীন ও মুক্ত চিন্তায় অধিকারী ছিলেন। জগতের অনাদিত্ব বিষয়ে মুসলিম দার্শনিক ইমাম আল গাজালি এবং ইবনে রুশদের মতবাদ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মুসলিম দার্শনিকরা জগতের অনাদিত্বে বিশ্বাস করেন এবং তা প্রমাণ করার জন্য যুক্তি প্রদর্শন করেন। গাজালি জগতের অনাদিত্বে বিশ্বাস করেন না। তিনি দার্শনিকদের যুক্তিসমূহ খণ্ডন করতে প্রয়াস নেন। আর ইবনে রুশদ দার্শনিকদের মতবাদকেই কিছুটা সংস্কার করে জগতের অনাদিত্বের পক্ষেই যুক্তি দিয়েছেন।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, জগতের অনাদিত্ব সম্পর্কে ইবনে রুশদ যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার গুরুত্ব অপরিসীম। যদিও জগতের অনাদিত্ব বিষয়টি ইসলাম অনুমোদন করে না। ইসলাম ধর্ম মতে জগৎ আল্লাহর সৃষ্টি। তিনি তার ইচ্ছায় জগৎ সৃষ্টি করেছেন। এক সময় কোনকিছুই ছিল না কেবল আল্লাহ ছিলেন। তিনি ইচ্ছা করলেন জগৎ সৃষ্টি করতে তাই জগৎ সৃষ্টি করলেন।