জনগণের নেতা বলতে কী বুঝায়? বিশ্বের দুইজন নেতার সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জননেতা এবং সফল স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: পৃথিবীতে মানুষ তার কর্মের মধ্য দিয়ে হয়ে উঠে মহান; চিরস্মরণীয় ও বরণীয়। এজন্যই উইলিয়াম শেক্সপিয়র বলেছিলেন, “Some are born great, some achieve greatness, some have greatness thrust upon them.” যখন কোনো ব্যক্তি জনগণের প্রত্যাশা বা চাহিদা পূরণে নিজের সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে অবিরত কাজ করে তখন তিনিই জনপ্রিয় হয়ে উঠেন, পরিণত হন জনগণের নেতায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন একজন ব্যক্তি যিনি বাংলার স্বায়ত্তশাসন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও শোষণ বৈষম্যহীন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন এবং এজন্য অনেক নির্যাতনও ভোগ করেছেন। তার অদম্য ও অক্লান্ত নেতৃত্বে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য হয়েছে। জনগণের নেতা: প্রাচীনকাল থেকেই যুগে যুগে নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের মুক্তি অথবা পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে

দেশকে স্বাধীন করার জন্য যেসব নেতা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদেরকেই মহান নেতা বলা যায়। এসব নেতার নৈতিক চরিত্র, সাহসিকতা, ব্যক্তিত্ব, দূরদর্শিতা, নিঃস্বার্থপরায়ণতা দেখে মানুষ মুগ্ধ হয়েছে, মানুষ তাদের ভালোবেসেছে। আর এভাবেই তারা জনগণের নেতায় পরিণত হয়েছেন। জনগণের নেতা হিসেবে নেলসন মেন্ডেলা, মাও সে তুং, জর্জ ওয়াশিংটন, ইয়াসির আরাফাত, মহাত্মা গান্ধী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রমুখ মহান ব্যক্তিত্বের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।

বিশ্বের দুইজন অসলেতার সাথে বঙ্গবন্ধুর তুলনা: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনক জর্জ ওয়াশিংটন ও মিশরের জামাল আবদেল নাসেরের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে উনিশ শতকের জাতীয়তাবাদী চিন্তায়, বিশ শতকের প্রাগ্রসর মুক্তচিন্তার অগ্নিস্ফুলিঙ্গের যোগ ঘটিয়েছেন। তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতায়।

প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের সাথে বঙ্গবন্ধুর তুলনা: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা যুদ্ধের সেনাপতি ও প্রথম
প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের সাথে বঙ্গবন্ধুকে তুলনা করা যেতে পারে। জর্জ ওয়াশিংটনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। পিতা ও বড় ভাইয়ের কাছে লেখাপড়া শেখেন। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন এবং কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। যুবক বয়সে ওয়াশিংটন সার্ভেয়ার হিসেবে কাজ শুরু করে অল্প সময়ে প্রভূত দক্ষতা অর্জন করেন। যুবক বয়সে বঙ্গবন্ধু রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং অল্পতেই নিজস্ব সক্রিয়তা ও বুদ্ধিমত্তার জোরে দলীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন। জর্জ ওয়াশিংটন ২০ বছর বয়সে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন এবং যুদ্ধের বিরল অভিজ্ঞতা ও অসামান্য সফলতা লাভ করেন। ২৭ বছর বয়সে মার্থা নামক মহিলাকে বিবাহ করেন এবং প্রভূত সম্পত্তির মালিক হন। যা তাকে ভার্জিনিয়ার সবচেয়ে সম্পদশালী ব্যক্তিতে পরিণত করে। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাপতি নিযুক্ত হয়ে অত্যন্ত কৌশলী নীতি গ্রহণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে রক্ষা করে স্বাধীনতা এনে দেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা পরবর্তীতে সর্বসম্মতিক্রমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি দুই মেয়াদ প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করে রাজনীতি হতে অবসর গ্রহণ করেন।

অপরদিকে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণতন্ত্রের দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অধিকার আদায়ে সময়োপযোগী একের পর এক সফল কর্মসূচি দেন, যা জনগণ স্বাগত জানায়। যেমন- ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের পর ১৯৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ এর ছয়দফা, ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রভৃতি, এরূপ নীতি ও পরিকল্পনা বঙ্গবন্ধুকে জননেতায় পরিণত করে। আর তাই তিনি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ও জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন, যা বিশ্বের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে স্বীকৃত এবং এটি আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণের সাথে তুলনীয়।

জামাল আবদুল নাসেরের সাথে বঙ্গবন্ধুর তুলনা: নবীন মিশরে অনেক নেতা জন্মেছেন তবে কেউই মিশরের ইতিহাস নয় বরং ইতিহাসের অংশ মাত্র। কিন্তু ইতিহাস বলতে যাকে বুঝায় তিনি হলেন জামাল আবদেল নাসের। মিশরের রাজা ফারুকের সেনাবাহিনীর কর্নেলের পদ থেকে নাসের হন মিশরের স্রষ্টা। মিশরকে বলা হয় ‘নাসেরের মিশর’। নাসের আর মিশর আজ পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটিকে আরেকটি ছাড়া ভাবাই যায় না। যেমন বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাস কল্পনা করা যায় না।

পঞ্চাশের দশকের শুরুতেই মিশরের আরব জাতীয়তাবাদের নবজন্মের মতো বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদের নবজন্ম লক্ষণীয়। নাসেরের মধ্যে চরিতার্থ হয়েছে আরব জাতির বিশেষ করে মিশরের কয়েক শতাব্দীর পুনর্জাগরণের স্বপ্ন। অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে চরিতার্থ হয়েছে বাংলাদেশের কয়েক শতাব্দীর রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জাগরণের স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক খ্যাতি শুরু পঞ্চাশের দশকের সূচনায়। এ সময়েই নাসেরের ক্ষমতা আরোহণ হয়। নাসেরের রাজনীতির জাদুমন্ত্র হলো আরব জাতীয়তাবাদ। আর বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির জাদুমন্ত্র হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ। নাসেরকে যুদ্ধ করতে হয়েছে প্রতিক্রিয়াশীল সামন্ত স্বার্থ, পশ্চাৎমুখী ধর্মান্ধতা ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধুও ধর্মান্ধতা, প্রতিক্রিয়াশীল সামন্ত স্বার্থের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছেন। তিনি এ সামন্ত স্বার্থের পৃষ্ঠপোষক পশ্চিম পাকিস্তানের উদীয়মান ধনবাদী স্বার্থ এবং তার পৃষ্ঠপোষক পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভূমিকা পালন করেন। নাসেরের রাজনৈতিক শিক্ষার পটভূমিতে রয়েছে অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের সশস্ত্র সংঘর্ষের কৌশল। নাসের ছিলেন সামরিক কৌশলে বিশ্বাসী।

অপরদিকে, বঙ্গবন্ধু গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। নাসেরের আন্দোলন সশস্ত্র। তাই তিনি আঘাতকারী ও সহসা বিজয়ী। মুজিবের আন্দোলন নিরস্ত্র। তাই তিনি অসহযোগী ও বার বার নির্যাতিত।
সফল স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর

সফল স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য: বৈশিষ্ট্যগুলো নিচে আলোচনা করা হলো:

১. ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতা : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। একজন সফল নেতার নেতৃত্বের যে সমস্ত গুণাবলি থাকা প্রয়োজন তার সবই বঙ্গবন্ধুর মধ্যে বিদ্যমান ছিল। তিনি অযথা ও অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতেন না বা জনগণকে মিথ্যা আশ্বাস দিতেন না। তিনি যা বলতেন তা পূরণের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতেন।

২. দূরদর্শিতা : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অত্যান্ত দূরদর্শী। তিনি মওলানা ভাসানীর কথায় স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়ে অত্যন্ত ধীরে, পরিবেশ পরিস্থিতি উপলব্ধি করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। যা তার দূরদর্শিতারই পরিচয় বহন করে।

৩. সাহসী: বঙ্গবন্ধু ছিলেন সাহসী প্রকৃতির একজন মানুষ। তার প্রমাণ মেলে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে বসবাস করে ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং নতুন রাষ্ট্রের দাবি যা তার যথেষ্ট সাহসিকতার পরিচয় বহন করে।

৪. ন্যায়পরায়ণ ও নির্লোভ: বঙ্গবন্ধু ছিলেন ন্যায়পরায়ণতার ক্ষেত্রে আপসহীন। তিনি সত্যের ক্ষেত্রে সহজ ন্যায়ানুগ আর মিথ্যার ক্ষেত্রে ছিলেন কঠোর ও কঠিন। তিনি ছিলেন নির্লোভ। ইচ্ছা করলেই তিনি পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ ধনী এবং সর্বাধিক ক্ষমতাশীল হতে পারতেন। পাকিস্তানের গভর্নর বা প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা হননি। তিনি জনগণের সাথে কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করেননি।

৫. মানবতার প্রতীক: একজন সফল নেতৃত্বের অন্যতম হচ্ছে তিনি হন মানবতাবাদী। বঙ্গবন্ধু যেখানেই অন্যায়, অবিচার, শোষণ দেখেছেন তার বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। এজন্য তাকে বার বার শাসকগোষ্ঠীর কড়া শাসনে পড়তে হয়েছে। তার রাজনৈতিক জীবনের অর্ধেক সময়ই তাকে জেলে থাকতে হয়েছে। তবুও তিনি ছিলেন অনড়।

৬. জনগণের নেতা : বঙ্গবন্ধু ছিলেন জনগণের নেতা। তিনি জনগণকে আপন সন্তানের মতো ভাবতেন। তাইতো তিনি জনগণকে ‘তুমি’ সম্বোধনে ডাকতেন। জনগণও তাকে পিতৃতুল্য ভাবত যার কারণে তারাই তাঁকে ‘জাতির পিতা’ ঘোষণা দিয়েছে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, বঞ্চনা, লাঞ্ছনা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য বাংলার জনগণকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে দারুণভাবে জাগিয়ে তোলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাঙালিদের মধ্যে আত্মত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করেন। বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে, স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেন। বাঙালি জাতিকে সংগঠিত করেন স্বাধীনতার মন্ত্রে। বঙ্গবন্ধু পরিণত হন বাঙালির অবিসংবাদিত জননেতায়।