জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিপন্থি কি না? আলোচনা কর।

অথবা, আতীয়তাবাদ কী আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিপন্থি। যুক্তি দেখাও।

অথবা, আন্তর্জাতিকতাবাদ কী? “আতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিপন্থি নয়”- উক্তিটি বর্ণনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: জাতীয়তাবাদ হলো একটি রাজনৈতিক আদর্শ। যেসব রাজনৈতিক আদর্শ রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করেছে তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদ অন্যতম। জাতীয়তাবাদের আত্মিক আবেদন পরাধীন জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করেছে। Lioyed বলেছেন, “Nationalism is the religion of the modern world.” সুতরাং মানবসভ্যতার পরিপ্রেক্ষিতে একটি রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে জাতীয়তাবাদের আলোচনা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। বর্তমানকালে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা জাতীয় রাষ্ট্রের সমন্বয়ে গঠিত। আর জাতীয় রাষ্ট্রের ভাব বা আদর্শকে জাতীয়তাবাদ বলে গণ্য করা হয়।

আন্তর্জাতিকতাবাদ: আন্তর্জাতিকতাবাদ হচ্ছে জাতীয়তাবাদের মতোই একটি মানসিক ধারণা, যা বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলার পথনির্দেশ করে। এটার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সমগ্র বিশ্বে শাস্তি ও সংহতি প্রতিষ্ঠা করা।

প্রামাণ্য সংজ্ঞা: আন্তর্জাতিকতাবাদ সম্পর্কে বিভিন্ন মনীষী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্ন ধরনের মতবাদ প্রদান করেছেন। নিম্নে তাঁদের কয়েকটি সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো:

বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গোল্ডস্মিথ (Goldsmith) বলেছেন, “আন্তর্জাতিকতাবাদ হলো এমন এক ধরনের অনুভূতি, যা ব্যক্তিকে কেবল তার নিজ রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবেই নয়, বিশ্বের একজন নাগরিক হিসেবেই ভাবতে শেখায়।” (Internationalism is the feeling that the individual is not only a member of his state but a citizen of the world.)

Pandit Vishnu Sharma বলেছেন, “আন্তর্জাতিকতাবাদ হলো এমন একটি মানসিক ধারণা, যা সংকীর্ণমনা মানুষকে বৃহৎমনা এবং একটি বৈশ্বিক পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করতে সহায়তা করে।” (Internationalism is the concept of mind and it prevails among the narrow minded people, the broad minded people considered the world as their family.)

ড. অনাদি কুমার মহাপাত্র বলেছেন, “আন্তর্জাতিকতাবাদ হলো সাম্য ও সহযোগিতার ভিত্তিতে এক শান্তিপূর্ণ বিশ্বসমাজ প্রতিষ্ঠা, বৃহৎ ক্ষুদ্র, সবল দুর্বল নির্বিশেষে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা।

জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিপন্থি কি না: রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে জাতীয়তাবাদ জাতীয় সার্বভৌমত্ব, জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিটি জাতির নিজ নিজ সত্তা এবং ব্যক্তিত্বের স্ফুরণে অকুন্ঠ অনুপ্রেরণার সঞ্চার ঘটিয়ে এক প্রোজ্জ্বল অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে, অন্ধ স্বদেশপ্রীতি, জাতিগত সংকীর্ণতা এবং মতান্ধতা, অন্য জাতির প্রতি বিদ্বেষ, জাত্যাভিমান, জাতিগত প্রাধান্য বিস্তারের লোলুপতা, জাতির শৌর্য প্রতিষ্ঠার জন্য পররাজ্য গ্রাস প্রভৃতির মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ বারবার সভ্যতাকে ধ্বংসের অন্ধকূপে নিক্ষেপ করেছে। জাতীয়তাবাদের এ বিকৃত ও ভয়ঙ্কর রূপ বিশ্ব সভ্যতার প্রতি মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে নিম্নলিখিত যুক্তিসমূহ তুলে ধরা হলো:

১. বিকৃত জাতীয়তাবাদ আতি-বিদ্বেষে পরিণত হয়: সংকীর্ণ, আত্মকেন্দ্রিক, আমানী জাতীয়তাবাদী গ্রাম্য ভাতারা প্রতি বিদ্বেষ ও হিংসার ইন্ধন যুগিয়েছে। নিজ জাতি সম্পর্কে অহেতুক প্রাধান্যের ধারণা এবং অন্য জাতির সৃষ্টি পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। অন্ধ স্বদেশীরি ও সভ্যতার প্রতি ঘৃণার মনোভাব বিকৃত জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে বারংবার আত্মপ্রকাশ করেছে।

২. সংকীর্ণ চিন্তা: জাতীয়তাবাদের আরেকটি প্রধান ত্রুটি হলো, এ জাতীয়তাবান রাজনৈতিক চিন্তার দিগন্তকে সংকীর্ণ করে দেয়। আঞ্চলিকতা অনেক ক্ষেত্রেই সংকীর্ণ চিন্তাজনিত গ্রাম্য রাজনীতির রূপ পরিগ্রহ করে। কোন জাতির স্বকীয়তা রক্ষার প্রয়াস বিচ্ছিন্ন বর্বরতার আকার ধারণ করে।

৩. সামরিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের পথপ্রদর্শক: বিকৃত জাতীয়তাবাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত প্রত্যেক জাতির মধ্যে সাম্রাজ্য প্রসারের নীতি ধীরে ধীরে গড়ে উঠে। সাম্রাজ্য বিস্তার ও যুদ্ধের মধ্যে জাতীয় শৌর্য এবং গৌরবের পূর্ণতার চেষ্টা করা হয়। অন্য জাতিকে পদানত করে নিজের জাতির মহত্ত্ব প্রতিষ্ঠার এ চেষ্টা সাম্রাজ্যবাদের রূপ নেয়। সামরিকতাবাদ বিকৃত জাতীয়তাবাদের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। এ প্রসঙ্গে H. J. Laski বলেছেন, “As power extend nationalisem becomes transformed into imperialism.”

৪. বিরোধী তত্ত্ব প্রচার: অন্ধ জাতীয়তাবাদ অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নানাপ্রকার বিরোধী তত্ত্ব প্রচার করে। এ মনোভাবের ফলে স্বৈরাচার, অত্যাচার, মহামারি ও দুর্ভিক্ষের দ্বারা উৎপীড়িত কোন জাতির রাষ্ট্রীয় জীবনের বিপর্যয়ে অন্য কোন সভ্য জাতির পক্ষে নির্লিপ্ত মনোভাব অবলম্বন করা সম্ভব নয়।

৫. সুস্থ মানবিক সংস্কৃতি বিকাশের বিরোধী: উগ্র জাতীয়তাবাদ সমগ্র মানবজাতির মানবিক গুণাবলি, সংস্কৃতি ও সভ্যতা বিকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তাদের সৃজনশীল বিকাশের পথ রুদ্ধ করে। সংকীর্ণ ও বিকৃত জাতীয়তাবাদ নিজেদের দেশ ও সমাজের সাংস্কৃতিক বিকাশের তুলনায় ক্ষমতা ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার দিকে অধিক উদ্যোগ গ্রহণ করে। অন্ধ পরজাতি বিদ্বেষ, আক্রমণাত্মক নীতি, সমরবাদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক মননশীলতা গড়ে তোলার। জন্য জাতির সর্বাত্মক বৈচিত্র্যপূর্ণ বিকাশের পরিবর্তে বিকৃত সাংস্কৃতিক ধারণার সৃষ্টি করে।

৬. ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের উদ্ভব: রাজনৈতিক স্বাধীনতার তত্ত্ব হিসেবে জাতীয়তাবাদ জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের নীতির মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু ঐ নীতি চরমভাবে প্রয়োগ করলে প্রতিটি বড় রাষ্ট্রই শতধাবিভক্ত রাষ্ট্র হতে বাধ্য। এভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটলে অনেক নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি হবে।

৭. স্বৈরাচারের জন্ম দেয়: জাতীয়তাবাদের নামে অনেক ক্ষেত্রে বৃহৎ জাতীয় জনসমাজ ক্ষুদ্র জাতীয় জনসমাজ ও গোষ্ঠীর উপর প্রাধান্য বজায় রাখতে চায়। এ প্রকার জাতীয়তাবাদ স্বৈরাচারের জন্ম দেয়।

৮. বিশ্বশান্তির পরিপন্থি: উগ্র জাতীয়তাবাদ বিশ্বশান্তি এবং সৌভ্রাতৃত্বের পরিপন্থি। জাতির আত্মগরিমা প্রতিষ্ঠা করাই তার একমাত্র লক্ষ্যে পরিণত হয়। এক্ষেত্রে পারস্পরিক বুঝাপড়া এবং যুক্তির পরিবর্তে যুদ্ধ এবং বলপ্রয়োগের নীতির মাধ্যমে সকল উদ্যোগ ও লক্ষ্যের পরিপূর্ণতা সাধনের চেষ্টা করা হয়।

৯. অর্থনৈতিক স্বার্থের পরিপন্থি: জাতীয়তাবাদের অর্থনৈতিক দিকও উপেক্ষা করা যায় না। জাতীয়তাবাদ কোন জাতির নিজস্ব অর্থনৈতিক স্বার্থ বজায় রাখার ক্ষেত্রে এমনভাবে অনুপ্রাণিত করে যে, বৃহৎ জাতিসমূহ বৈদেশিক ব্যবসায় বাণিজ্য, বৈদেশিক বাজার দখলের জন্য বিদেশে উপনিবেশ স্থাপন, যুদ্ধ পরিচালনা করতে দ্বিধাবোধ করে না।

১০. অগণতান্ত্রিক: জাতীয়তাবাদের এ উগ্র, হিংস্র ও বীভৎস প্রকাশ গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা ও সমস্ত মানবিক চেতনার পরিপন্থি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, “জাতীয়তাবাদ সভ্যতার সংকটস্বরূপ।” উগ্র জাতীয়তাবাদে অগণতান্ত্রিক প্রকৃতি প্রকাশ পায়। এ প্রসঙ্গে Prof. Hayes বলেছেন, “Nationalism is artificial and it is far from, is the word it is patriotic snobbery.”

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায় যে, উগ্র এবং সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ সাম্রাজ্যবাদ ও সামরিকতাবাদে পরিণত হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে ইতালি ও জার্মানির শাসকশ্রেণি নিজেদের সাম্রাজ লোলুপতার নীতি রূপায়ণের জন্য আগ্রাসী জাতীয় মনোবৃত্তি সঞ্চারিত করেছিল। অনেকেই বিশ্বাস করেছিলেন ইতালি এবং জার্মানি জাতির মহিমা ও গৌরব প্রতিষ্ঠার জন্য সাম্রাজ্য বিস্তার প্রয়োজন। সুতরাং এ জাতীয়তাবাদ সামরিকতাবাদে পরিণত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে জাপান বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে সুদূর প্রাচ্যে নিজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য সামরিকতাবাদের আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। সুতরাং একথা বলা যায়, জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিপন্থি নয় কিন্তু উগ্র জাতীয়তাবাদ সভ্যতা ও আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিপন্থি।