জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মধ্যে বৈসাদৃশ্যসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মধ্যে পার্থক্য বর্ণনা কর।

অথবা, জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মধ্যে বৈপরীত্য দেখাও।

উত্তর: ভূমিকা: বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক চিন্তাজগতে জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ হলো দু’টি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। বর্তমান শতাব্দীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নতি, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ে রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, দু’টি বিশ্বযুদ্ধ, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবসভ্যতার অস্তিত্ব রক্ষা প্রভৃতি কারণে জাতীয়তাবাদ বনাম আন্তর্জাতিকতাবাদের সমস্যাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পার্থক্য বা বৈসাদৃশ্যসমূহ: জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ উভয়ে উভয়ের পরিপূরক হলেও উভয়ের মধ্যে কিছু পার্থক্য বা বৈসাদৃশ্য রয়েছে। নিম্নে বৈসাদৃশ্যসমূহ আলোচনা করা হলো:

১. বিশ্বশান্তি বিনষ্ট: জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণার জন্য পৃথিবীতে যুদ্ধের আবহাওয়া ও মানবসভ্যতার সঙ্কট সৃষ্টি হয়। জাতীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস ও সন্দেহের সম্পর্ক, স্বার্থদ্বন্দ্ব প্রভৃতি কারণে বিশ্বমৈত্রী ও বিশ্বশান্তি প্রভৃতি আন্তর্জাতিকতার আদর্শের প্রসারে বাধাপ্রাপ্ত হয়। অতএব বলা যায়, জাতীয়তাবাদ বিশ্বশান্তি নষ্ট করে আর আন্তর্জাতিকতাবাদ তা রক্ষার চেষ্টা করে।

২. অয়ান্য জাতির প্রতি হিংসা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি: জাতীয়তাবাদ নিজের জাতি সম্পর্কে অতান্ত গর্ব ও দাম্ভিকতা প্রকাশ করে এবং অন্যান্য জাতির প্রতি ঘৃণা ও হিংসা বিদ্বেষ পোষণ করার মানসিকতা সৃষ্টি করে, যা আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিপন্থি। হিটলার জার্মান জাতিকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি বলে মনে করত।

৩. জাতীয়তাবাদ সাম্রাজ্যবাদের আকার লাভ করে: জাতীয় রাষ্ট্রগুলো বিভিন্ন অজুহাতে অনেক সময় অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে। ক্রমে ক্রমে সে রাষ্ট্রে তাদের কর্তৃত্ব ও প্রতিপত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত করে নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করে। এটা আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিপন্থি।

৪. জাতীয়তাবাদ ঔপনিবেশিকতাবাদে পরিণত হতে পারে: অনেক সময় শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহ এবং শিল্পজাত দ্রব্য বিক্রয়ের জন্য শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলো অনুন্নত দেশসমূহে উপনিবেশ স্থাপনের প্রয়াস চালায়। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এটা আন্তর্জাতিকতাবাদ সমর্থন করে না।

৫. আন্তর্জাতিকতাবাদ আতীয়তাবাদকে ম্লান করে দেয়: আন্তর্জাতিকতাবাদ বিশ্বশান্তির নামে অনেক সময় রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে, যা জাতীয়তাবাদ বিকাশের পরিপন্থি। আন্তর্জাতিকতাবাদ বিশ্বশান্তির নামে জাতীয় রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করে তার উপর অনেক বিধিনিষেধ জারি করে। ফলে জাতীয়তাবাদ ক্ষুণ্ণ হয়।

৬. জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতার জন্য হুমকিস্বরূপ: আধুনিক বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিবিদ্যার যুগে বৃহৎ শক্তিসমূহ মারাত্মক যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে একে অপরের মুখোমুখি হয়ে থাকে। যে কোন সময় এ অস্ত্রের ব্যবহার হলে বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত হবে। এমনকি মানবসমাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে পারে। ফলে দেখা যায় জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতার জন্য হুমকি হিসেবে কাজ করে।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মধ্যে কিছু বৈসাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। উভয়ই একে অপরের পরিপূরক এবং উভয়ই একে অপরের উপর নির্ভরশীল। তবে উগ্র জাতীয়তাবাদ মানবসমাজ তথা আন্তর্জাতিকতাবাদের জন্য হুমকিস্বরূপ।