অথবা, জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা দাও।
অথবা, জাতীয়তাবাদ বলতে কী বুঝ?
উত্তরঃ ভূমিকা: আধুনিক কালে রাজনৈতিক অঙ্গনে জাতীয়তাবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে পরিচিত। জাতীয়তাবাদকে রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে অভিহিত করলেও তা অত্যুক্তি হবে না। কেননা এ উপাদান বিশ্বরাজনীতির ক্ষেত্র পরিবর্তনে একটি গতিশীল শক্তি এবং বিশ্ব মানচিত্রের পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম। ইউরোপেই প্রথম জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে।
জাতীয়তাবাদ: ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটি ইংরেজি ‘Nationality’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ। Nationality শব্দটির উদ্ভব ঘটেছে ল্যাটিন শব্দ ‘Natus’ বা ‘Natia’ থেকে। যার অর্থ জন্ম। এদিক থেকে Nationality বা জাতীয়তাবাদ বলতে বুঝায় একই আদর্শ থেকে জন্ম নেওয়া জনসমষ্টি। সাধারণভাবে জাতীয়তাবাদ বলতে বুঝায় এমন এক সংঘবদ্ধ জনসমষ্টিকে; যারা মানসিক, আদর্শিক এবং চেতনায়
ঐক্যবদ্ধ। মূলত দীর্ঘদিন ধরে একই ভৌগোলিক সীমারেখায় বসবাসকারী জনসমষ্টির মধ্যে ভাষা, বংশ, বর্ণ, কৃষ্টি, ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি বিষয়ে মিল থাকার কারণেই তাদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতা গড়ে উঠে। আর এ ঐক্যবদ্ধতাই তাদেরকে অন্যের থেকে নিজেদেরকে আলাদা করে ভাবতে শেখায় এবং তারা নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী জাতীয় জীবন গড়ে তোলার মানসিকতা লাভ করে। এভাবে যখন কোন জনসমষ্টি ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী জাতীয় জীবন পরিচালনার মানসিকতা লাভ করে তখনই বলা হয়ে থাকে যে জাতির মধ্যে জাতীয়তাবাদ জন্ম নিয়েছে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট জনসমষ্টির মানসিক বিদ্যানুভূতিই জাতীয়তাবাদ নামে পরিচিত।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা: বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ বিভিন্নভাবে জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা দিয়েছেন। নিচে তাঁদের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হলো:
এল. স্লাইডার (L. Snyder)-এর মতে, “জাতীয়তাবাদ হচ্ছে ইতিহাসের এক বিশেষ স্তরে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আধ্যাত্মিক চেতনার ফল; একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে বসবাসকারী জনগণের মনমানসিকতা ও
ভাবগত ঐক্যই এর প্রধান
শর্ত।” (Nationalism is a product of political, economic, social and
intellectual factors at a certain stage in history, is a condition of mind, feeling or sentiment of a
group of people living in a well defined geographical area.)
অধ্যাপক লয়েড (Prof. Lioyd)-এর ভাষায়, “জাতীয়তাবাদ একটি ভাবগত বা মানসিক ধারণা বিশেষ।” (Nationalism is the religion of the modern world.)
আরনল্ড জে. টয়েনবি (Arnold J. Toynbee) বলেন, “জাতীয়তাবাদ কোনরূপ বস্তুগত বা যান্ত্রিক অনুভূতি নয়, বরং একপ্রকার আত্মিক ও মানসিক অনুভূতি।” (Nationalism is nothing material or mechanical, but a subjective psychological feeling in a living people.)
কার্লটন জে. হায়েস (J. Hayes)-এর মতে, “জাতীয়তাবাদ হলো জাতীয়তা এবং দেশপ্রেমের মতো পুরানো দুই প্রত্যয়ের আধুনিক কালের আবেগপ্রবণ সংমিশ্রণে উচ্ছ্বসিত মানসিকতায় অতিরঞ্জন।” (Nationalism consists of modern emotional fusion and exaggeration of two very old phenomena nationality and patriotism.) অধ্যাপক হ্যারল্ড জে, লাস্কি (Harold J. Laski)-এর মতে, “জাতীয়তাবাদ সাধারণত একপ্রকার মানসিক ঐক্যবোধে উদ্বুদ্ধ জনসমাজ এবং এ ঐক্যবোধ উক্ত জনসমাজকে বাকি মানবসমাজ হতে পৃথক করে।”
অধ্যাপক অরগানস্কি (Organski) বলেন, “জাতীয়তাবাদ হলো এক ধরনের অতি শক্তিবান এক অনুভূতি; আর এ অনুভূতিই কোন জাতি এবং তার জীবনযাত্রার ভিত্তিরূপে পরিগণিত
ধরনের সাথে কোন ব্যক্তির শনাক্তকরণের পথ রচনা করে।”
রিচার্ড ডব্লিউ, কোটাম (Richard W. Cottam) এর মতে, “জাতীয়তাবাদ হলো একটি বিশ্বাস, যা একটি জাতির মধ্যে পরিস্ফুটিত হয়। যে জাতি স্বাধীনভাবে নিজেদের সবকিছুকেই গৌরবের সাথে গ্রহণ করে।”
হেজ (Hage) বলেন, “জাতীয়তাবাদ হলো জাতীয় জনসমাজ এবং স্বদেশপ্রেম নামক দুটি প্রাচীন উপাদানের আধুনিক আবেগমণ্ডিত সমন্বয় ও অতিরঞ্জন।”
বার্নস (Burns)-এর মতে, “প্রত্যেক মানবগোষ্ঠীর মধ্যে কিছু বিশেষ গুণ আছে, যা তাদের স্বার্থ ও কল্যাণের জন্য সংরক্ষণ করা উচিত। এটা করতে গিয়ে যে মনোভাবের জন্মলাভ হয় সেটাই হলো জাতীয়তাবাদ।” ফারসি লেখক রেনাঁন-এর মতে, “জাতীয়তা একটি মানসিক সত্তা, একপ্রকার সজীব মানসিকতা।”
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায়, জাতীয়তাবাদ এমন একটি মানসিক অনুভূতি ও অনুপ্রেরণা সমষ্টি, যা কোন জাতির স্বাজাত্যবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমষ্টি সংস্কৃতিতে ঐক্যবদ্ধ চেতনার প্রতিফলন ঘটায়। বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি হলো জাতীয়তাবাদ। বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ বিকাশ লাভ করে। জাতীয়তাবাদ একটি গতিশীল শক্তি।