অথবা, ঋাতীয় জনসংখ্যা নীতি-২০০০ অনুযায়ী জনসংখ্যা কার্যক্রমের মৌলিক পদ্ধতি বর্ণনা কর।
ভূমিকা: বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতি পূরণ দেশ হলো বাংলাদেশ। ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ ছোট দেশটিতে ১৪ কোটিরও বেশি লোক বসবাস করে। এদেশের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা সেক্টর কার্যক্রমের (HPSP) আওতায় ‘জনসংখ্যা কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং দেশের জনসংখ্যাকে সহনীয় পর্যায়ে সীমিত রাখার প্রয়াসে জনসংখ্যা নীতি ও রনসংখ্যা কার্যক্রমের মৌলিক কর্মকৌশল করা হয়েছে।
জাতীয় জনসংখ্যা নীতির মৌলিক কর্মকৌশল: জাতীয় জনসংখ্যা নীতির মূল উদ্দেশ্য হলো সার্বজনীনভাবে বাংলাদে/শের জনগণের জন্য গ্রহণযোগ্য মানের অত্যাবশ্যক স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আরও ‘কমিয়ে আনা। এ কার্যক্রমের লক্ষ্য জনসংখ্যা কার্যক্রম জোরদার করা এবং সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে দরিদ্র ও কম সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠীর বিশেষ করে দরিদ্র মহিলা ও শিশুদের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিয়ে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে ব্যয়-সাশ্রয়ী ও টেকসই কার্যক্রম পরিচালনা করা।
১. কার্যক্রমের ব্যপ্তিঃ জনসংখ্যা কর্মসূচি বাস্তবায়নের সামগ্রিকভাবে Client Centered Approach করে পরিবার পরিকল্পনা সেবাসহ সকল অত্যাবশ্যক সেবা প্রদান নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অত্যাবশ্যক সেবার উপাদানসমূহ হবে:
(ক) প্রজনন স্বাস্থ্য পরিচর্যাঃ নিরাপদ মাতৃত্ব প্রসূতি প্রসব- পূর্ব, প্রসবকালীন ও জরুরি পরিচর্যা (Eoc), পরিবার পরিকল্পনা সেবা। আর টি আই/এসটিডি/এইডস/এইচ আইভি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ, মায়েদের পুষ্টি, বিপজনক গর্ভপাত প্রতিরোধ, বয়ঃসন্ধি (কিশোর-কিশোরী) সেবা। বন্ধ্যাত্ব সংক্রান্ত চিকিৎসা, নবজাতকের সেবা।
(খ) শিশু স্বাস্থ্য পরিচর্যা: শ্বাসনালীর তীব্র সংক্রমণ ডায়রিয়া জাতীয় ব্যাধিসমূহ। টিকা দ্বারা প্রতিরোধযোগ্য রোগসমূহ ই পি আই কার্যক্রম। ভিটামিন এর অভাবজনিত ব্যাধি/ পঙ্গুত্ব প্রতিরোধ। বিদ্যালয় স্বাস্থ্য কার্যক্রম।
(গ) সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণঃ যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, কালাজ্বর, কৃমি, এসটিডি/ আরটি আর, অন্যান্য নতুন এবং পুনর্বার আবির্ভূত রোগসমূহ।
(ঘ) সীমিত উপশমমূলক সেবা: প্রাথমিক চিকিৎসা সহায়তা, জরুরি (আঘাত, কাটা, পোড়া ইত্যাদি) ব্যথা নিরসনে প্রয়োজনীয় সেবা ও উপদেশ। এ কার্যক্রমের আওতায় গ্রামাঞ্চলের অতি সাধারণ রোগসমূহ যেমন- হাঁপানি, চর্ম, চক্ষু, দাঁত ও কানের রোগ ইত্যাদি নিরাময়ের ব্যবস্থা রয়েছে।
(ঙ) যোগাযোগের মাধ্যমে আচার ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনঃ বাংলাদেশের অনেকগুলো রোগ প্রতিরোধ করা যায় শুধুমাত্র মানুষের অভ্যাস এবং আচার-আচরণের পরিবর্তন (খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে ভিটামিনের অভাজনিত সমস্যার সমাধান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধ ইত্যাদি) এর মাধ্যমে একইভাবে সেবা প্রদানকারীদের ও মন-মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আবশ্যক। এ সকল দিক বিবেচনার HPSP এর আওতায় যোগাযোগের মাধ্যমে আচার-দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন (Behviour Change Communication)-কে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এ ব্যবস্থায় সামাজিক ও নারীপুরুষের (Gender Equity) পৌঢ় ও দরিদ্র ব্যক্তিবর্গের সহায়তা বিষয়াদি গুরুত্ব পাবে। অত্যাবশ্যক সেবা, কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ও থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মাধ্যমে প্রদান করা হয়।
২. কার্যক্রম ব্যবস্থাপনাঃ জনগণের জন্য সেবা কার্যক্রম যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা হবে। এ লক্ষ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি পুনর্গঠন পর্যায়ক্রম সম্পন্ন করা হবে। প্রাথমিকভাবে উপজেলা ও মাঠ পর্যায়ে কর্মসূচি সমন্বিত করে একক কাঠামোর আওতায় আনা হবে সে অনুযায়ী।
(ক) একটি একক ইউনিট এর মাধ্যমে Out Reach পুরোপুরিভাবে একীভূত করা হবে এবং কার্যক্রমের একটি Uniform তালিকার মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনা সেবাসহ কার্যক্রমকে একক ব্যবস্থাপনা কর্তৃত্বের আওতায় পরিচালিত হবে।
(খ) স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবাকে প্রত্যেক নাগরিকের নাগালের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতি ৮০০০ জনসংখ্যার জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হবে। মাঠ পর্যায়ে কর্মরত সকল পরিবার পরিকল্পনা কর্মী/স্বাস্থা কর্মী/প্যারামেডিকসদের ভূমিকা, দায়িত্ব, কার্যপরিধিসহ চাকরির অবস্থান পুনঃনির্ধারণপূর্বক পরিবর্তিত সেবার চাহিদা মেটানো হবে।
(গ) ইউনিয়ন পর্যায়ে সকল স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সেবা কেন্দ্র পুরোপুরি একত্রীভূতভাবে একক ব্যবস্থাপনার আওতায় এনে সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা, দায়িত্ব এবং কার্যপরিধি পুনঃনির্ধারণ পূর্বক তৃণমূল পর্যায়ে সেবার চাহিদা মেটানো হবে।
(ঘ) একজন থানা ব্যবস্থাপকের অধীনে থানার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা একীভূত করে একক সংগঠন ও ব্যবস্থাপনার আওতায় আনার মাধ্যমে সেবা প্রদান নিশ্চিত করা হবে।
(ঙ) সম্পদের সর্বাধিক ও কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য এ পুনর্গঠন কার্যক্রমের আওতায় বেসরকারি ব্যক্তিগত খাত এবং অন্যান্য স্থানীয় সংস্থার সাথে নেটওয়ার্ক জোরদার করে সেবা প্রদান করা হবে উপরক্ত স্থানীয় সরকারকে সম্পৃক্ত করে সম্পদের সর্বোত্তম ও কার্যক্রম ব্যবহার নির্ধারণপূর্বক স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা সেবা নিশ্চিত করা হবে।
৩. কার্যক্রমের জবাবদিহিতা স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ: জনগণের জন্য সেবা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য কর্মসূচির ক্ষেত্রে সেবা প্রদানকারীদের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। প্রতিটি ক্ষেত্রে Stakeholder Community Participation নিশ্চিত করে কার্যক্রম ব্যবস্থাপনার উন্নতি সাধন করে কার্যক্রমে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কর্মসম্পাদনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করা হবে। এ বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য এর সাথে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকার দায়িত্ব পালন করবে।’
৪. ব্যয় সাশ্রয়তা নিশ্চিতকরণঃ জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির ব্যয়-সাশ্রয় করা অপরিহার্য। চাহিদা অনুযায়ী সম্পদের সার্বিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে Cost Sharing Cost Recovery পন্থা উদ্ভাবন করে সেবার মান বৃদ্ধি করার পাশাপাশি অপচয় কমিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে অতি দরিদ্র শ্রেণির ক্লায়েন্টগণ Cost Sharing ও Cost Recovery কার্যক্রমের আওতাভুক্ত থাকবে। এ ছাড়া স্বাস্থ্য বিমা পলিসি প্রবর্তনের মাধ্যমে ব্যয় সাশ্রয়তা নিশ্চিত করা হবে।
৫. পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির জন্য সরকারের সম্পদ বরাদ্দ নিশ্চিতকরণ: আর্থিক স্বনির্ভরতা অর্জনের একটি প্রধান লক্ষ্য বৈদেশিক সাহায্যোর উপর নির্ভরতা দ্রুত কমিয়ে আত্মনির্ভরতা অর্জন। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সরকারকে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব থেকে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা খাতে বরাদ্দের হার বাড়াতে হবে।
৬. পরিবার পরিকল্পনা সেবার খরচের অংশীদারিত্বঃ সরকারের বরাদ্দ বাড়ালেও ক্রমবর্ধমান এই খাতের ব্যয় সংকুলাল সম্ভব হবে না। অতএব, পর্যায়ক্রমে খরচের অংশীদারিত্ব প্রচলন করতে হবে। খরচের অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে তিনটি প্রদান পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে।
(ক) ব্যবহারকারীর কাছ থেকে ফি আদায় করা; এর মূল্য এবং সেবা প্রদান খরচ এবং দ্রব্যাদির মূল্য অন্তর্ভুক্ত হবে।
(খ) স্থানীয় সরকার কর্তৃক অর্থায়ন এবং
(গ) স্থানীয় সমাজের দ্বারা অর্থায়ন।
৭. উপকরণের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সিস্টেম লস কমানোঃ স্বনির্ভরতা অর্জনের আর একটি প্রধান উপায় হলো সিস্টেম নাম কমানো। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিতে চালু উপকরণগুলোর কার্যকর ব্যবহার বাড়ানো এবং কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি। সেবার মূল্য হিসেবে যে অর্থ আদায় হবে তা স্থানীয়ভাবে ব্যবহারের জন্য এবং এই সংগৃহীত অর্থ সেবার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য খরচ করার নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
৮. মহিলাদের ক্ষমতায়ন ও পুরুষের অংশগ্রহণ: পরিবার পরিকল্পনা ব্যবহারে মহিলাদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তাই এই কর্মসূচিতে মহিলাদের ক্ষমতায়ন বৃদ্ধির লক্ষ্যে উদ্ভাবনীমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করার সাথে সাথে ব্যক্তি ও পারিবারিক পর্যায়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিষয়ে পুরুষের দায়িত্ব ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং সে বিষয়ে আচরণ পরিবর্তনমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা।
৯. প্রয়োজনীয় জনবল নির্ধারণঃ সময় ও প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেও পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম নিয়োজিত জনবলের চাহিদা পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে জনবলের পর্যালোচনা ও পুনঃনির্ধারণ করার ব্যবস্থা থাকবে। চাহিদার আলোকে জনবলের ধরন নির্ধারণপূর্বক দক্ষতা বৃদ্ধি করে জনবলের সামগ্রিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
১০. মানব সম্পদ উন্নয়ন: স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য মানব সম্পদের জ্ঞান ও দক্ষতা সর্বোচ্চ সুফল অর্জনের জন্য একটি সঠিক ও চাহিদা মাফিক মানব সম্পদ উন্নয়নের কৌশল গড়ে তুলতে হবে। কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য চাহিদা মাফিক তৃণমূল পর্যায় থেকে প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান বাস্তবে প্রয়োগের জন্য ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে।
১১. তথ্য ব্যবস্থাপনা : ও কর্মসূচির বাস্তবে অগ্রগতি ও অবস্থা নিরূপণের জন্য তথ্য ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই। কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কর্ম পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং মনিটরিং এর জন্য একীভূত তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিকে (UMIS) আরও জোরদার ও বিস্তৃত করা হবে এবং কম্পিউটার যোগাযোগ ব্যবস্থা সারাদেশে প্রতিষ্ঠা করা হবে।
১২. বহুমূল্লী কর্মসূচিঃ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ছাড়াও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের (শিক্ষা, তথ্য, কৃষি, ধর্ম, যুব ও ক্রীড়া, সমাজকল্যাণ, মহিলা ও শিশু: স্বরাষ্ট্র, কর্মসংস্থান প্রভৃতি) আওতায় দেশের ক্রমবর্ধিষ্ণু জনসংখ্যা সীমিত করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমে এ সকল কর্মসূচির দ্বৈততা পরিহার করতে হবে। ব্যবস্থাপনার উন্নতি সাধন এবং তার পাশাপাশি এ সকল সামগ্রী উৎপাদনে দেশীয় শিল্পের বিকাশ ঘটানোর জন্য দেশীয় শিল্পগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, জাতীয় জনসংখ্যা নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে মানুষের উন্নয়নের মূল উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে যে কোনো জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান সম্পদ হিসেবে। এ সকল কর্মকৌশল বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমানো সম্ভব হবে।