অথবা, জাতীয় নারী উন্নয়নের নীতির প্রধান প্রধান ক্ষেত্রগুলো আলোচনা কর।
অথবা, জাতীয় নারী উন্নয়ন রীতি প্রধান প্রধান ধারাগুলো উল্লেখ কর।
অথবা, জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির প্রধান প্রধান দিকগুলো তুলে ধর।
ভূমিকা: পুরুষ শাসিত সমাজের ধর্মীর কুসংস্কার ও গোঁড়ামি সামাজিক কুসংস্কার, নিপীড়ন ও জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বৈষম্যের বেড়াজাল নারীদের সর্বদা রেখেছে অবদমিত। নারীর মেধা ও মননশীলতা ব্যয়িত হচ্ছে রান্না আর গৃহস্থলির কাজে। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা নারীকে সমাজ উন্নয়নে সম্পৃক্ত করার পথে বাধার দেয়াল তুলে রেখেছে। সংবিধানে নারীদের সমান অধিকারসহ নারী-পুরুষ বৈষম্য নিরসনের কথা বলা হলে ও সুনির্দিষ্ট নীতির অভাবে নারী উন্নয়নকে মূল ধারায় নেয়া সম্ভব হয়নি। এরই প্রেক্ষিতে বিদ্যমান নারী-পুরুষ ও ছেলে শিশু বৈষম্য রোধ করে মেয়ে শিশুদের সকল প্রাধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে নারীদের উন্নয়নের মূল স্রোত ধারায় নিম্নে আসার লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি।
জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির প্রধান প্রধান দিকসমূহ: নিম্ন নারীদের উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির প্রধান প্রধান দিকসমূহ আলোচনা করা হলোঃ
১. নারীর মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ: নারীর মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতা সকলে ক্ষেত্রে যেমন- রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ যে সম-অধিকারী। তার স্বীকৃতিস্বরূপ নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ করা। নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (CEDAW) এর প্রচার ও বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
২. কন্যা শিশুর উন্নয়ন: বাল্য বিবাহ, কন্যা শিশু ধর্ষণ, নিপীড়ন, পাচারের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ করা, কন্যা শিশুর চাহিদা যেমন- খাদ্য, পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে বৈষম্যহীন আচরণ করা ও বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা এ নীতির মূল লক্ষ্য।
৩. নারীর প্রতি সকল নির্যাতন দূরীকরণ: ও পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে এবং কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি শারীরিক, মানসিক ও যৌন নিপীড়ন, নারী ধর্ষণ, যৌতুক, পারিবারিক নির্যাতন, এসিড নিক্ষেপ সহ-নারীর প্রতি সকল প্রকার সহিংসতা দূর করা।
৪. সশস্ত্র সংঘর্ষ ও নারীর অবস্থাঃ সশস্ত্র সংঘর্ষ ও জাতিগত যুদ্ধে নারীর অধিকতর নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিরুদ্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা। সংঘর্য বন্ধ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা, আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার মিশনে নারী প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা।
৫. শিক্ষা ও প্রশিক্ষণঃ নারী শিক্ষা বৃদ্ধি, নারী-পুরুষের মধ্যে শিক্ষার হার ও সুযোগের বৈষম্য দূর করা এবং উন্নয়নের মূলধারায় নারীকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে শিক্ষানীতি ২০১০ অনুসরণ করা। নারীর নিরক্ষরতা দূর করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। বিশেষত কন্যা শিশু ও নারীসমাজকে কারিগরি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ সকল বিষয়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদানের উপর গুরুত্বারোপ করা।
৬. ক্রীড়া ও সংস্কৃতি: ক্রীড়াক্ষেত্রে নারীর বর্ধিত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, স্থানীয় পর্যায়ে নারীর জন্য পৃথক ক্রীড়া কমপ্লেক্স গড়ে তোলা, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে নারীর বর্ধিত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এই নীতির উল্লেখযোগ্য উদ্দেশ্য।
৭. দারিদ্র্য দূরীকরণ : নারীর দারিদ্রদ্র্য দূরীকরণ হতদরিদ্র নারীদের সামাজিক নিরাপত্তা বলে অন্তর্ভুক্ত করা, বিধবা ও দুস্থ মহিলাদের ভাতা প্রণয়ন, বয়স্ক বাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রণয়ন ও বিত্তহীন মহিলাদের খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি অব্যাহত রাখা জাতীয় নারী নীতির প্রধান দিক।
৮. নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন: নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে জরুরি বিষয়াদি হলো- স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, জীবনব্যাপী শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, আয়বর্ধক প্রশিক্ষণ, তথ্য ও প্রযুক্তিতে নারীকে পূর্ণ ও সমান সুযোগ প্রদান করা। উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি, এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা।
৯. নারীর কর্মসংস্থানঃ নারীর শ্রম শক্তির শিক্ষিত ও নিরক্ষর উভয় অংশের কর্মসংস্থানের জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করা। চাকরি ক্ষেত্রে নারীর বর্ধিত কোটা ও নিয়োগ নিশ্চিত করার কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। সকল নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে সরকার অনুসৃত’ কোটা ও কর্মসংস্থান নীতির আওতায় চাকরি ক্ষেত্রে সকল প্রকার সুযোগ প্রদানের জন্য উদ্বুদ্ধ করা।
১০. নারী ও প্রযুক্তি : নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন, আমদানি ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে জেন্ডার প্রেক্ষিত প্রতিফলিত করা, উদ্ভাবিত প্রযুক্তির প্রয়োগের ফলে নারীর স্বার্থ বিঘ্নিত হলে গবেষণার মাধ্যমে ঐ প্রযুক্তিকে নারীর প্রতি ক্ষতিকারক উপাদানযুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা আর একটি প্রধান দিক।
১১. নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন: রাজনীতিতে অধিক হারে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য প্রচার মাধ্যমসহ রাজনৈতিক দলসমূহকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণে উদ্বুত্ত করা। নারীর রাজনৈতিক অধিকার অর্জন ও প্রয়োগ এবং এর সুফল সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা, রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে পর্যায়ক্রমে ৩৩ শতাংশে নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতকরণ।
১২. নারীর প্রশাসনিক ক্ষমতায়ন: প্রশাসনিক কাঠামো উচ্চ পর্যায়ে নারীর জন্য সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করার সহজ লক্ষ্যে চুক্তিভিত্তিক এবং পার্শ্ব প্রবেশের ব্যবস্থা করা। প্রশাসনিক, নীতি নির্ধারণী ও সাংবিধানিক পদে অধিক হারে নারীদের নিয়োগ প্রদান করা, জাতিসংঘের বিভিন্ন শাখা ও অঙ্গ সংগঠনে এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনে রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি বা প্রার্থী হিসেবে নারীকে নিয়োগ/মনোনয়ন দেয়া।
১৩. স্বাস্থ্য ও পুষ্টিঃ নারীর জীবন চক্রের সকল পর্যায়ে যথা- শৈশব, কৈশোর, যৌবন, গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসহ নারীর স্বাস্থ্য সম্পর্কিত গবেষণা করা এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্যের প্রচার ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা। নারীর জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা শক্তিশালী করা। মাতৃ মৃত্যু ও শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস করা।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, উপর্যুক্ত বিষয়সমূহ ছাড়াও যেসকল প্রধান দিকের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সেগুলো হলো: নারির গৃহায়ন ও আশ্রয়, নারী ও পরিবেশ দুর্যোগকালীন, দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে নারী ও শিশুর সুরক্ষা, অনগ্রসর ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নারীর জন্য বিশেষ কার্যক্রম, প্রতিবন্ধী নারীর জন্য বিশেষ কার্যক্রম প্রভৃতি।