ডালহৌসির সাম্রাজ্য নীতি পর্যালোচনা কর।

অথবা, রাজ্য জয়ের জন্য ডালহৌসি যে নীতি অনুসরণ করেন তা বিশ্লেষণ কর।

অথবা, ডালহৌসির সাম্রাজ্য নীতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দাও।

উত্তর : ভূমিকা: ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসে লর্ড ডালহৌসি সাম্রাজ্যবাদী শাসক হিসাবে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ভারতীয় উপমহাদেশে যে সকল গভর্নর জেনারেল প্রেরণ করেছেন তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি শুধুমাত্র সাম্রাজ্য বিস্তারই করেননি বরং বিভিন্ন ধরনের কৃতিত্বপূর্ণ কার্যাবলি সম্পাদন করেছেন। তিনি সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে কতিপয় নীতি মেনে চলেন। এসব নীতি ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছিল।

ডালহৌসির সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি: সাম্রাজ্য বিস্তার নীতির ক্ষেত্রে ডালহৌসি তিনটি নীতি অবলম্বন করেছিলেন। যথা-

(ক) স্বত্ব বিলোপনীতি।

(খ) কুশাসনের অজুহাতে পররাজ্য অধিকার।

(গ) প্রত্যক্ষ যুদ্ধের মাধ্যমে রাজ্য বিস্তার।

(ক) স্বত্ব বিলোপ নীতি: লর্ড ডালহৌসির সাম্রাজ্য বিস্তার নীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ স্বত্ব বিলোপ নীতির মাধ্যমে রাজ্য বিস্তার। এ নীতির মূল কথা ছিল ব্রিটিশের অনুগ্রহে এবং প্রশ্রয়ে যে সকল দেশীয় রাজ এবং শের উৎপত্তি হয়েছিল সেসব রাজবংশের কোনো উত্তরাধিকারী না থাকলেও রাজ্যগুলো প্রত্যক্ষভাবে ব্রিটিশ সম্রাজ্যভুক্ত হয়ে পড়বে। দত্তক পুত্রের – উত্তরাধিকার ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক স্বীকৃত হবে না। স্বত্ব বিলোপ নীতির উদ্ভাবন হিসেবে পরিচিত হলেও লর্ড ডালহৌসি এককভাবে এ ব্যবস্তার জন্যে দায়ী নন।

স্বত্ব বিলোপ নীতির প্রয়োগ ও রাজ্য দখল: এ নীতির প্রয়োগ দ্বারা ডালহৌসি সর্বাধিক সংখ্যক রাষ্ট্রকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। এ নীতির প্রয়োগ দ্বারা তিনি নিম্নোক্ত রাজ্যসমূহের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।

১. সাতারা: সর্বপ্রথম স্বত্ব বিলোপ নীতি প্রয়োগ করা হয় সাতারা রাজ্যে। সাতারার রাজা ব্রিটিশ সরকারের অনুমতি ব্যতীত দত্তক পুত্র গ্রহণ করেছিলেন। ১৮৪৮ সালে রাজার মৃত্যুর পর ডালহৌসি দত্তক পুত্র গ্রহণ অবৈধ ঘোষণা করে রাজ্যটিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।

২. সম্বলপুর ও নাগপুর: ১৮৫০ সালে সম্বল পুরের রাজা অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে তিনি রাজ্যটিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। ১৮৫৩ সালে নাগপুরের ভোঁমলে রাজ্যের ভাগ্যেও একই ঘটনা ঘটে।

৩. উদয়পুর, ঝাঁসি, ভগৎ, করৌলি: ১৮৫৩ সালে ঝাঁসির রাজা অপুত্রক অবস্থা প্রাণ ত্যাগ করলে ঝাঁসি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। একই কারণে উদয়পুর, কোরৌলি রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।

৪. কর্ণাট ও তাঞ্জোর: ১৮৫৩ সালে কর্ণাটের নবাব পরলোক গমন করলে তার উত্তরাধিকারীকে বাৎসরিক বৃত্তি হতে বঞ্চিত করা হয়। ১৮৫৩ সালে তাঞ্জোরের রাজার মৃত্যুর পর ঐ রাজ পরিবার থেকে রাজা উপাধি উঠিয়ে দেওয়া হয়।

(খ) কুশাসনের অজুহাতে পররাজ্য দখল এ নীতির দ্বারা তিনি নিম্নোক্ত রাজ্যগুলো দখল করেন।

১. অযোধ্যা: লর্ড ডালহৌসি তার সাম্রাজ্য বিস্তারের তৃতীয় পক্ষ হিসেবে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও কুশাসনের অজুহাতে ১৮৫৩ খ্রি. অযোধ্যা রাজ্যটি দখল করেন। ড. এম. এন সেন বলেন, অযোধ্যার নবাব পরিবারের প্রতি বর্বরোচিত ব্যবহার ও নিষ্ঠুর আচরণ ব্রিটিশ জাতির মর্যাদায় কলঙ্ক লেপন করেছিল।

২. বেরার: ব্রিটিশ সৈন্যের ব্যয়ভার বহনের টাকা বাকি পড়ায় হায়দ্রাবাদের নিজামের নিকট হতে বেরার প্রদেশটি কেড়ে নিয়ে তিনি তা ব্রিটিশ অধিকারভুক্ত করেন।

(গ) প্রত্যক্ষ যুদ্ধের রাজ্য বিস্তার: ডালহৌসি রাজ্য বিস্তার নীতির ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ যুদ্ধাভিযান নীতিও অবলম্বন করেন। এ যুদ্ধের মাধ্যমে তিনি নিম্নোক্ত রাজ্যসমূহ দখল করেন:

১. পাঞ্জাব দখল: মূলরাজ ১৮৫৮ সালে লাহোরের রেসিডেন্ট জ্যান্স ওগনিউ এবং এন্ডার সন নামক দুজন ব্রিটিশ কর্মচারীকে হত্যা করে সুলতানে স্বীয় কর্তৃত্ব পুনঃ প্রতিষ্ঠা করেন। এর ফলে পাঞ্জাবের শিখ সৈন্যগণ বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ১৮৪৯ সালে লর্ড ডালহৌসি শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। অতঃপর ডালহৌসি ১৮৪৯ সালের ৩০ মার্চ এক ঘোষণার দ্বারা পাঞ্জাব ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।

২. পেগু অধিকার: প্রথম ইঙ্গ-ব্রহ্ম যুদ্ধের পর থেকে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি বর্মাদের মনোভাব বিদ্বেষপূর্ণ ছিল। ১৮৫১ সালে কয়েকজন ব্রিটিশ বণিক বর্মাদের হাতে অপদস্ত ও লাঞ্ছিত হয়। এই ক্ষতিপূরন দাবি করতে গিয়ে নৌসেনাপতি ল্যাম্বাট ব্রহ্ম রাজ্যের এ্যার্ট জাহাজ দখল করেন। ১৮৫২ সালের ১৪ এপ্রিল ব্রিটিশ সৈন্য রেঙ্গুন অধিকার করে। ব্রহ্মরাজ ব্রিটিশদের সাথে সন্ধি করতে অস্বীকৃতি জানালে ডালহৌসি সমগ্র পেণ্ড অধিকার করেন।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ডালহৌসি স্বত্ব বিলোপ নীতির দ্বারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রসারতাকে বহুগুণে বৃদ্ধি করেন। এতে তিনি ব্রিটিশদের প্রশংসাও অর্জন করেছিলেন। তবে ভারতবাসীর মনে এ নীতি দারুণ অসন্তোষ ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল। তার স্বত্ব বিলোপ নীতি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নীতির অন্যতম প্রতীক।